রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: পাখিটির কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কালেঙ্গা পৌঁছাতেই মধ্যাহ্ন। সরকারি বাংলোয় ব্যাগপত্তর রেখে ঝটপট বনে ঢোকার তোড়জোড়।
ছোটখাটো টিলার উপর ছিমছাম টিনের ঘর। সামনেই চিলতে উঠোন, ধার দিয়ে সারি সারি আম-কাঁঠালের গাছ। ঘন কাঁঠাল পাতার ভেতর লুকিয়ে একনিষ্ঠ ধ্যানীর মতো ডেকে চলেছে পাখিটি।
আমাদের তখন বন টানছে, এতসব দেখার কী সময় আছে! বন ঘুরে সন্ধার আগ দিয়ে ফিরে এসে আবার বেরিয়েও গেলাম। তখনও চলছে ডাকাডাকি।
রাতের বনকাণ্ড শেষ হলো দু’টোর দিকে। দিন-রাত মিলে এত এত হাঁটা হয়েছে যে, হাঁটুর নিচে কিছু রয়েছে বলে সাড় হচ্ছে না! দু’চোখে উথাল-পাথাল ঘুম। ওদিকে, ডাকাডাকি থামেনি কিন্তু!
হাইতোলা সকালে ঘুম ভাঙতেই কানে এলো সেই পাখিটির বিরহী ডাক। বউ কথা কউ। প্রাণের বউটি বোধহয় অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে অন্য ডালে বসে রয়েছে। কথা কইবে না। এদিকে, মান ভাঙাতে বর ডেকে চলেছে অহর্নিশ।
ভালো নাম ইন্ডিয়ান কুকু। কোকিল গোত্রীয় এ পাখিটি অতি উচ্চস্বরে চারটি অংশ সুর করে ডেকে ওঠে। সেগুলো হলো- অরেঞ্জ-পিকো, বো-ক-টা-কো, ক্রসওয়ার্ড পাজল বা ওয়ান মোর বোটল। অঞ্চলভেদে সুরের ভিন্নতা খুব কমই দেখা যায়। বাংলা ভাষায় বো-ক-টা-কো-কেই আঞ্চলিকভাবে ‘বৌ কথা কও’ নামে অভিহিত করা হয়। এজন্য নামও হয়ে গেছে বউ কথা কও।
চীনে এ সুরটির মাধ্যমে শেষ থেকে জেগে ওঠাকে নির্দেশ করে। ভারতের কাঙ্গরা উপত্যকায় এ ডাককে ‘হোয়ার ইজ মাই শিপ’ হিসেবে শোনা যায়। যে ডাকে মৃত রাখালের আত্মা ঘুরে বেড়ায় বলে প্রচলিত রয়েছে।
রেমা-কালেঙ্গার ভোর আপনাকে ছোট্টবেলার সেই ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইলো’ ছড়াটি মনে করাবেই করাবে! মনে হবে, বইয়ের পাতা থেকে যেন এইমাত্র জীবন্ত হয়ে উঠলো কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা লাইনটি!
চারদিকে বনের নিস্তব্ধতা। মাঝে-মধ্যে দেখা মেলে পর্যটক ও স্থানীয় পথচারীর। এর মধ্যেই কানে ভেসে আসে হরেক প্রজাতির পাখির সুরেলা গান। কোকিল ও ঘুঘুসহ বিভিন্ন প্রজাতির হৃদয় ছোঁয়া কলকাকলীতে মিলবে অন্যভুবনের প্রশান্তি।
উঁচু-নিচু টিলা আর ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কোনো গাছের ডালে হয়তো সবুজ ঘুঘুটি চুপটি করে বসে রয়েছে। কোথাওবা গাইছে দোয়েল-কোয়েল।
ফুড়ুৎ করে দেখা দিতে পারে বাংলা বাবুই (ব্ল্যাক-ব্রেস্টেড ওয়েভার)। পাখিটির দৈর্ঘ্য ১১ সে.মি. ও ওজন মাত্র ১২৫ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ও ছেলেপাখির চেহারা দেখতে একই রকম। তবে প্রজনন মৌসুমে ছেলেপাখির মাথার ছাঁদি হলুদ হয়ে যায়। এরা জলাশয়ের আশেপাশে ঘাসের সুক্ষ্ম লম্বা ফালি ও নলে পাতা দিয়ে ঝোলানো বাসা তৈরি করে থাকে।
শুধু কী তাই, হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক টিয়ে। ঝাঁক বেঁধে কিচির-মিচির শব্দ করে পাকা আমে ঠোকর বসাচ্ছে।
গভীর বনের লেকগুলোতে পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় উভচর পাখির দেখাও পেয়ে যাবেন। আরও গভীর বনে গাছের মগডালে দেখা মিলবে ৩৫ বছর আগে আন্তর্জাতিকভাবে (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-আইইউসিএন) বিলুপ্ত ঘোষিত কয়েকটি শকুন। যা রেমা-কালেঙ্গা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও মিলবে না।
রয়েছে ছোট আকারের খুড়লে পেঁচা। এর ইংরেজি নাম স্পটেড আউলেট। এদের দৈর্ঘ্য ২০ সে.মি. ও ওজন মাত্র ২০ গ্রাম। এরা রাতের আঁধারে বিশেষ করে রাস্তার ধারের লাইটগুলোতে উড়ে এসে শিকার ধরে খায়। খাদ্য তালিকায় রয়েছে উড়ন্ত পোকা, ইঁদুর, টিকটিকি, ছোট পাখি প্রভৃতি। দিনে গাছের খুড়লে লুকিয়ে থাকে বলে নামও তাই।
এছাড়াও পাখিদের মধ্যে রয়েছে ভীমরাজ, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, ঈগল ও চিল প্রজাতির বিভিন্ন পাখি।
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের রেঞ্জ অফিসার শেখ আ. কাদির জানান, সুন্দরবনের পরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ অভয়ারণ্যে সবুজ ঘুঘু ও বিলুপ্ত প্রজাতির শকুনসহ ১৬৭ প্রজাতির পাখি রয়েছে। অভয়ারণ্যের ময়না বিল এলাকার ২০০টি উঁচু গাছ চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা হয়েছে শকুনের নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে।
ফিরে আসি শুরুর কথায়। স্ত্রী ইন্ডিয়ান কুকু বোধহয় বড্ড বেশি অভিমানী। কে জানে কবে তার মান ভাঙবে! মেঘে মেঘে বেলা গড়ায়। একবুক প্রেম নিয়ে ডেকে চলে প্রেমিক পুরুষ..
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৭ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৫
এসএস
** বন্যপ্রাণীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়াশ্রম
** পাহাড়ের ভাঁজে অরণ্যের দিনরাত্রি