ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

রেমা-কালেঙ্গার বন-পাহাড়ে-৪

যে রাস্তায় অটোরিকশা হয়ে যায় সিন্দ‍াবাদের জাহাজ!

শুভ্রনীল সাগর, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন ও জিয়া উদ্দিন দুলাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২১ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৫
যে রাস্তায় অটোরিকশা হয়ে যায় সিন্দ‍াবাদের জাহাজ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: সুন্দরবনের পরে সবদিক দিয়ে রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এছাড়া শুকনো ও চিরহরিৎ এ বন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল।



এত বিশেষত্বের পরও এ বনাঞ্চল অধিকাংশের কাছে অপরিচিত। ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কোথায় যাচ্ছি। রেমা-কালেঙ্গার নাম বলতেই প্রায় সবাই অবাক। এটি আবার কী! 

বনে গিয়ে ভীষণ দুঃখ হলো। এমন নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার কিনা মানুষের জানার বাইরে রয়ে গেল! যেখানে রেমা-কালেঙ্গার নখেরও যোগ্য নয়, এমন সব পুঁচকে বন প্রচার-প্রচারণা ও পর্যটকদের আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে। কারণ জানতে কথা হয় বন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় বাসিন্দা ও দু-একজন পর্যটকের সঙ্গে। সবাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রধান কারণ হিসেবে দেখালেন, বেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থা।


ঢাকা থেকে রেমা-কালেঙ্গা দুইভাবে যাওয়া যায়। এক, সরাসরি শায়েস্তাগঞ্জ গিয়ে সেখান থেকে সিএনজিচালিত ‍অটোরিকশা চেপে। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে রেমা-কালেঙ্গার দূরত্ব সাড়ে ২৭ কিমি.।

দুই, শ্রীমঙ্গল গিয়ে সেখান থেকে সরাসরি জিপগাড়ি চেপে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রেমা-কালেঙ্গার গেট। রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্য রাস্তাটি দারুণ সোনায় সোহাগা। দূরত্ব প্রায় ২৫ থেকে ২৬ কিমি.’র মতোই। বলে রাখা ভালো, জিপগাড়ি আর ছোট ট্রাক ছাড়া এ পথে অন্যকিছু চলে না। এছাড়া বর্ষাকালে কাদা জমে চলার অবস্থায় থাকে না বলে পথটি বন্ধ থাকে।

তবে বেশিরভাগই শায়েস্তাগঞ্জের পথটি বেছে নেন। এদিক দিয়ে যেতে পড়বে চুনারুঘাট উপজেলার চামলতলী গ্রাম। এ গ্রামের করাঙ্গী ব্রিজ অব্দি এসে শেষ হয়েছে পাকা রাস্তা। মাটির বুক চিরেই যেতে হবে শেষ চার-পাঁচ কিমি. পথ।
 

অন্যসময় যা হোক, বর্ষাকালে এই পথ হয় দেখার মতো! অবাক হলেও সত্যি, অটোরিকশাগুলো বনে যায় পুরদস্তুর জাহাজ! গন্তব্যে পৌঁছানোই যেহেতু মুখ্য, তাই উপায় নেই- যেতেই হবে।

ধীরে গেলে অটোরিকশা আটকে যায়। আবার দ্রুত গেলে সমুদ্রঝড়ে পড়া সিন্দ‍াবাদের জাহাজের মতো দোলে! তবুও এখানে দ্রুত যাওয়াই একমাত্র উপায়।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বর্ষা মৌসুমে অটোরিকশায় দুই পর্বের রাস্তার জন্য দু’জন চালক থাকেন। পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত রাস্তায় দ্রুততার সঙ্গে অনায়াসে চালিয়ে নেওয়ার জন্য একজন ‘বিশেষজ্ঞ’ চালক। যার দায়িত্ব শুধু ওই জলকাদার বৈতরণী পার করে নিয়ে যাওয়া।

ভালো বা পাকা রাস্তার জন্য অন্য একজন। বিশেষজ্ঞ চালকের পাশেই বসে থাকেন ‘সাধারণ’ চালক। কাদার বৈতরণী পার হয়ে গেলেই মূল ভূমিকায় আসেন তিনি। এ পথে নিয়মিত নন এরকম কোনো চালক নিয়ে এলে গোটা রাস্তা আপনাকেই ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে!


রাস্তার এমন দুরাবস্থার জন্যই আটকে রয়েছে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের সমস্ত সম্ভাবনা। বর্ষা মৌসুম মানেই এখানে তীব্র দুর্গতি! এখানকার পর্যটনশিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরাবস্থার কারণে, আক্ষেপ ফরেস্ট রেঞ্জ‍ার শেখ আ. কাদিরের।

ঢাকা থেকে রেমা-কালেঙ্গা ঘুরতে এসেছেন রিফাত আহমেদ ও তার ৩০ জন তরুণ সাইক্লিস্ট বন্ধু। বাইসাইকেল আরোহীর মধ্যে বনের ভেতর দিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা হবে। আরোহীদের এ বনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই এ উদ্যোগ


বাংলানিউজকে রিফাত বললেন, আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ বনের কোনো প্রচারণাই নেই। আমাদের দেশের অনেক মানুষই জানেন না যে, রেমা-কালেঙ্গা নামে একটি সমৃদ্ধশালী বন রয়েছে। এ বনকে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটনো সম্ভব।

সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের উচি‍ৎ, অতিসত্বর এ বনের দিকে নজর দেওয়া। এখানে আসার জন্য ভালো রাস্তা, পরিবহন, সংরক্ষিত এলাকায় বিদ্যুৎ, নিরাপদ থাকার ব্যবস্থাসহ নানা দিক পর্যটকবান্ধব করে তুলতে হবে। বাড়াতে হবে প্রচার-প্রচারণাও, যোগ করেন রিফাত।

এ বিষয়ে সংরক্ষিত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা তাজুল ইসলাম স্বপনের আবার অন্য অভিযোগ, এখানে মন্ত্রী-এমপিরা উন্নয়ন করতে চান না কারণ, তাদেরকে ‘খুশি’ করা হয় না।

এই ‘খুশি’র কারণও বুঝিয়ে বললেন, মন্ত্রী-এমপি’র চেলা-চামুন্ডাদের বনের গাছ কাটা বা গাছ পাচারে কোনোরকম সহযোগিতা না করাতেই তারা অখুশি। বন লুটেপুটে খেতে কালেঙ্গা বন বিভাগ ও স্থানীয়রা যদি ‍হাত মেলান, তাহলে দেখবেন আগামী ছয় মাসেই সব হয়ে যাবে! 


আবারও ফিরে আসি আ. কাদিরের কথায়, শীত মৌসুমে কিছু পর্যটক এলেও, বর্ষাকালে কেউ আসে না বললেই চলে। এখানে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে যানবাহনের অপ্রতুলতাই সবাইকে বেশি ভোগায়।   

অন্য একটি দুশ্চিন্তার দিকও তুলে ধরলেন, রাস্তাঘাট পাকা হলে পর্যটক বেশি করে এখানে আসতে শুরু করবে। এর ফলে আরেকটি সমস্যাও হয়তো দেখা দেবে। বেশি পর্যটক আসা-যাওয়ার ফলে অভয়ারণ্যের নিজস্ব পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়টিও ভেবে দেখার।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৫
বিবিবি/এসএস

** পাখির ডাকে রাত, পাখির ডাকে দিন
** বন্যপ্রাণীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়াশ্রম
** পাহাড়ের ভাঁজে অরণ্যের দিনরাত্রি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।