ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

কদর না থাকায় হারিয়ে গেছে বদরগঞ্জের যুগীরা

সাইফুর রহমান রানা, ডিভিশনাল স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৫
কদর না থাকায় হারিয়ে গেছে বদরগঞ্জের যুগীরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রংপুর: আর সব পেশার মতো সোনালি একটা সময় ছিল ‍তাদেরও।   ব্যাপক চাহিদা আর কদর থাকায় উদয়-অস্ত ব্যস্ততায় কাটতো তাদের দিন।

কি ছেলে, কি বুড়ো কারোরই একটু দম ফেলার ফুসরত নেই।

এরপর কালের পরিক্রমায় কমতে থাকে তাদের কদর, পণ্যের চাহিদা। একইসঙ্গে কমতে থাকে তাদের সংখ্যাও। কমতে কমতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাপ-দাদার পেশাটা ধরে আছেন কেবল একজন।

এ পাড়ার, গোত্রের সবার কাছে পিতৃপুরুষের পেশা এককালের স্বাচ্ছল্যের সুখস্মৃতি ভিন্ন এখন আর অন্য কিছুই নয়। আগের নামটা পোশাকি হিসাবে থেকে গেলেও এখন তাদের পরিচয় বিচিত্র পেশাজীবী।  

বলা হচ্ছে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার যুগী সম্প্রদায়ের কথা। ঝিনুক থেকে চুন তৈরিই ছিল যাদের একমাত্র পেশা। কিন্তু সময়ের চাহিদায় যান্ত্রিকভাবে পাথর থেকে চুন উৎপাদন শুরু হওয়ায় এখন যুগীদের পেশা বিলুপ্ত বললেই চলে।

সরেজমিনে যুগীপাড়ার গিয়ে জানা গেলো যুগীদের দিনানিপাতের বিচিত্র আখ্যান। রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরসভার পশ্চিম প্রান্তে ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন গ্রামটির নাম যুগীপাড়া। এখানে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবারের  বাস।

অনেক আগে থেকেই ঝিনুক থেকে চুন উৎপাদন তাদের জীবিকার মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে একটি পরিবার ছাড়া কেউই আর এ পেশায় নেই।

চাহিদা ও কদর না থাকায় বাধ্য হয়েই সবাই পৈতৃক পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এখন যুগী পাড়ার কেউ ছানা বিক্রি করেন, কেউ চালান রিকশা বা ভ্যান, কেউ করেন গালামালের ব্যবসা। এমনকি  ঢাকার বিভিন্ন গার্মেন্টসেও কাজ করছেন এ সম্প্রদায়ের অনেকে।

পাড়া ঘুরে জানা গেল, আধুনিক ও কৃত্রিমতার এ যুগে একজন মাত্র যুগী প্রাকৃতিকভাবে চুন তৈরির কাজটা ধরে রেখেছেন। তাও চলছে  খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
 
কথা হয় যুগীপাড়ার প্রবীণ ও যুগীচুন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা একমাত্র যুগী বিপিন দেবনাথের (৮৫) সঙ্গে। বয়সের ভারে ন্যূজ্ব তিনি। স্মৃতিচারণ করলেন বাপ-দাদার সময়ের তাদের স্বর্ণালী সময়ের।

বিপিন দেবনাথ জানান, যুগীচুন আমাদের বাপ-দাদারও আগের ব্যবসা। একটা সময় খুব ভাল ব্যবসা হতো। তখন নদীতে প্রচুর ঝিনুক পাওয়া যেত, জ্বালানির সংকট ছিলনা। বাজারে পাথুরে চুনও ছিলনা। বর্তমানে নদীতে পানি না থাকায় ঝিনুক পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তাও নদী থেকে লোক মারফত তুলে আনার খরচাও অনেক বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে জ্বালানি সংকট। সবচেয়ে বড় সমস্যা বাজারে পাথুরে চুনের দাপট।

তিনি জানান, চাহিদা না থাকাতেই যুগীরা এখন হারিয়ে গেছে। তার দুই ছেলের একজন গালামালের ব্যবসা ও অন্যজন কৃষিকাজ করে।

আক্ষেপ করে প্রবীণ এ যুগী বলেন, শরীরের জন্য উপকারী যুগীচুন শিল্পটি বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। তাই এটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অবশ্য এ প্রজন্মের যুগী ছেলে-মেয়েরাও চায় না তাদের মানুষ যুগী বলুক।

তবে তিনি যতোদিন বেঁচে থাকবেন, ততোদিন বাপ-দাদার এ পেশা কষ্ট করে হলেও চালিয়ে যাবেন বলে জানালেন একমাত্র যুগীশিল্পী বিপিন দেবনাথ ।

যুগীচুনের প্রস্তুত প্রণালী:
বিপিন দেবনাথের কাছে জানতে চাওয়া হয় যুগীচুন তৈরির প্রক্রিয়া। তিনি জানান, প্রথমে উত্তপ্ত আগুনের কুন্ডলিতে ঝিনুক দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট তাপে ঝিনুকের উপরের খোলস আলগা হয়ে ভেতরের সাদা অংশ বের হয়ে আসে। ওই সাদা অংশ পৃথক করে তা পাউডারের মতো করা হয়। পরে ছাকুনি দিয়ে পাউডারের ময়লা পরিষ্কারের পর তা গরম পানিতে দিয়ে চুন তৈরি করা হয়। এটা করতে কোনো ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়না।

যুগীচুন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় বদরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের রসায়ন বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক ইউনুস আলির কাছে। তিনি জানান, প্রাকৃতিক চুন শরীরের জন্য উপকারী। বাজারের পাথুরে চুনে প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নেই, বরং শরীরের জন্য ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে এ চুন।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৫
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।