রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: বনের ব্যাপকতা বোঝাতে কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করা যাক। ভৌগলিক অবস্থানে রেমা-কালেঙ্গা হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায়।
ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন ১৪২৮১ একর পাহাড়ি অঞ্চল বন বিভাগের সংরক্ষিত এলাকা। গোটা অঞ্চল রেমা, কালেঙ্গা, ছনবাড়ি ও রশিদপুর- এ চারটি বিটে ভাগ করা। বিস্তীর্ণ এ অঞ্চলটি যেহেতু প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, এজন্য বনের দেখভালের জন্য রয়েছে ১১টি ইউনিট ও ৭টি ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ৩টি কালেঙ্গা, ১টি ছনবাড়ি ও ৩টি রেমা বিটে।
১৪২৮১ একরের মধ্যে প্রায় ৪৪৩৭ একর এলাকা গড়ে উঠেছে জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য হিসেবে। এর সিংহভাগ কালেঙ্গা ও অল্প কিছু অংশ পড়েছে রেমা বিটে। এজন্য নাম রেমা-কালেঙ্গা কিন্তু মূল বিট আসলে কালেঙ্গা। সুন্দরবনের পরে সবদিক দিয়ে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি।
‘এমনও হয়েছে, নামাজ পড়তে বসে কেবল সালাম ফিরিয়েছি। এসময় খবর এলো গাছ কাটা হচ্ছে। মোনাজাত না করেই বন্দুক নিয়ে ছুট। গাছ কাটা হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ কিমি. দূরে। আর আমি এখানে। বনে তো গাড়ি-ঘোড়া চলে না, পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। এভাবে কি হয় বলেন’!
আক্ষেপ, প্রশ্ন, রাগ, বিরক্তি- সব একসঙ্গে মিশিয়েই বললেন ফরেস্ট রেঞ্জার শেখ আ. কাদির। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনের তিনিই সর্বেসর্বা ও প্রধান রক্ষক।
বাংলানিউজ টিম যখন রেমা-কালেঙ্গা পৌঁছায় তখন মধ্যাহ্ন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রেঞ্জার সাহেব বনের ভিতর। আমরাও বন ঘুরে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা। তখনও তিনি বনে। বন বিভাগের বাংলোয় একটু গড়িয়ে নিয়ে ঢু মারলাম রেঞ্জ অফিসে। রাত-দিন পার্থক্য করার জো নেই, রাতেও পুরোদস্তুর কাজ চলছে।
রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেই বলতে শুরু করলেন রেঞ্জার সাহেব, আপনাদের আসার খবর আগেই পেয়েছি। কিন্তু কী করবো বলেন, কাজের কী আর শেষ আছে! ১০ জনের কাজ একজনকে করতে হয়। শুধু আমি নই, সবারই একই অবস্থা।
ততক্ষণে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। আয়েশ করেই বলতে লাগলেন, যেখানে লোক লাগবে ৬৫, সেখানে রয়েছে ৩৩ জন। পাঁচজনের বিপরীতে দুইজন। পাচারকারীরা গাছ কাটতে আসে ২০ থেকে ২৫ জনের দল নিয়ে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা যাই মাত্র তিন থেকে চারজন। তাও একদল বনের একদিকে গেল তো অন্যদিকে, বন ধুয়ে নিয়ে গেলেও কিছু করার থাকে না।
আর বাকিরা? ‘বাকিদেরও একই অবস্থা। এই এত বড় বন মাত্র ৩৩ জনে সামলাই। চার বিটে সাত-আটজন করে পড়ে। এর মধ্যে কোর্টে হাজিরা দিতে গেলে দিন পার হয়ে যায়। পাচারকারীদের কেউ ধরা পড়লে তাদের নামে মামলা দেওয়া হয়। সেই কাজেই দিতে হয় হাজিরা’।
অবধারিতভাবে প্রশ্ন উঠলো লোকবল নিয়ে। এক কোণায় ঘাড়গুঁজে কাজ করছিলেন শামসুল আলম মজুমদার। পদবি ফরেস্ট গার্ড হলেও, কালেঙ্গা রেঞ্জ অফিসের সমস্ত দাফতরিক কাজকর্ম তাকেই সামলাতে হয়।
উত্তরটি তিনিই দিলেন, লোকবল বাড়বে কীভাবে, গত ১৫ বছর বন বিভাগে কোনো নিয়োগ হয়নি!
বলেই শামসুল আলম একবার রেঞ্জার সাহেবের দিকে, একবার আমাদের দিকে তাকান। ফস করে নিজেদের দফতর সম্পর্কে এরকম একটি তথ্য দিয়ে ফেলাটা ঠিক হলো কিনা সেটি নিয়ে দ্বিধান্বিত।
রেঞ্জারের অভয় ইশারা পেয়ে কাজ থামিয়ে শামসুল আলম দিলেন পরের প্রশ্নের উত্তর, নিয়োগ হয় না কারণ সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নতুন কোনো নিয়োগ দিতে হলে কর্মরতদের মধ্য থেকে ৩৩ শতাংশ পদোন্নতি দিতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, পদোন্নতি না দিয়েই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে। তখন বন বিভাগের মধ্য থেকে কেউ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। তখন নানা আইনি জটিলতায় শেষে নিয়োগই স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে যে পোস্টে ঢুকেছি, এখন পর্যন্ত সেই পোস্টেই কাজ করছি। এত সীমিত লোকবল যে সাপ্তাহিক-সরকারি বা এমনি কোনো ছুটিই কাটাতে পারি না, দিন-রাত এখানে কাজ করি। প্রতিবছর অবসরে যাওয়ায় বন বিভাগে লোক কমছে কিন্তু সেই তুলনায় নতুন লোক আসছে না। আমাদের দিকে সরকার যদি একটু নজর দিত, তাহলে আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করতাম! এক নিঃশ্বাসে বলে কাজে মন দিলেন শামসুল আলম।
অধীনস্তের এত অভিযোগের প্রেক্ষিতে আর কিইবা বলবেন রেঞ্জার অফিসার, তিনি নিজেই তো এর ভুক্তভোগী!
বাড়তি যোগ করলেন, এতবড় বন নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হওয়ায় ময়নাবিল নামে আরও একটি বিট করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি হয়ে গেলে সেখানেও লোক লাগবে। এখন যা রয়েছে তাও কমে যাবে। রেমা-কালেঙ্গা আবার পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠায় অন্য বিটের চেয়ে এখানে লোক বেশি লাগে। তারপরও তো বনকে ভালোবেসে আমরা সবাই এই ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছি।
ফোনে কথা হয় সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। সার্বিক পরিস্থিতি, বাস্তবতা ও অভিযোগ তুলে ধরা হয় তার কাছে।
সব বিষয়ে তিনি অবগত, এটি স্বীকার করে নিয়েই বললেন, বৃটিশ ও পাকিস্তান পিরিয়ডে যা ছিল, বাংলাদেশ আমলে সে তুলনায় লোকবল বাড়েনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বাড়ার যে চাপ, সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে সেই অনুপাতে লোকবল বাড়েনি। এজন্য বন মন্ত্রণালয় যে সচেষ্ট নয়, তা বলছি না।
তবে আপাতত বন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি চালু করেছি। সংরক্ষিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের বন সংরক্ষণের জন্য কমিটিতে নিয়েছি। তারা বনের ভেতর ও বাইরে থেকে পাহারা দেন। এর ফলে গাছ কাটা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে বলে জানালেন ডিএফও।
এছাড়াও যারা গাছ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের বন সংশ্লিষ্ট চাকরি দিয়ে, তারা যাতে আর গাছ না কাটেন সে ব্যবস্থা নিয়েছি। গাছ কাটা ও পাচার রোধে গণসচেতনতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছি, যোগ করেন তিনি।
বন রক্ষীদের নিরাপত্তা ও বন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে অন্য পর্বে।
আপাতত রেঞ্জার অফিসার আ. কাদিরের একটি আক্ষেপ দিয়েই শেষ করা যাক, ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম বন হিসেবে সবাই বলে কিন্তু সেই মর্যাদা নেই!’
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৯ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৫
এসএস
** সৌরবিদ্যুতে আলোকিত বনাঞ্চল
** যে রাস্তায় অটোরিকশা হয়ে যায় সিন্দাবাদের জাহাজ!
** পাখির ডাকে রাত, পাখির ডাকে দিন
** বন্যপ্রাণীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়াশ্রম
** পাহাড়ের ভাঁজে অরণ্যের দিনরাত্রি