শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ি কলোনি থেকে ফিরে: ঈদ-উল ফিতরকে সামনে রেখে রকমারি ডিজাইনের বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজে মহাব্যস্ত বেনারসি পল্লীর কারিগররা। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, তাই তাদের বসে থাকার কোনো উপায় নেই।
হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ি কলোনির এই বেনারসি পল্লী। তারপরও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসবে বাঙালি নারীদের নতুন কাপড়ের যোগান দিতে খটখট শব্দে মুখরিত হচ্ছে। ভোর থেকে গভীর রাতে পর্যন্ত চলছে শাড়ি বুননের কাজ। আর এ কাজগুলো চলে কয়েকটি ধাপে। শেষ পর্যায়ে এসে নারী-পুরুষ হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় রং-বেরংয়ের হাজারও সুতোই হয়ে ওঠে একেকটি আকর্ষণীয় শাড়ি। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতে চাইবে অনেকের।
দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি বধূর সাজসজ্জায় পোশাকের মধ্যে বেনারসি শাড়িই প্রধান বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সে শাড়িতেই যেন কেবল বাঙালি ললনাকে মানায়। আর তা যদি হয় উন্নতমানের তবে তো কোনো কথাই থাকে না। উন্নতমানের সেই বেনারসি শাড়ি তৈরি হচ্ছে বলেই সারা দেশ থেকে পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীদের ভিড় লেগেই আছে শেরপুরের এই নিভৃত পল্লীটিতে।
তবে এ শিল্পের বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি অনেক সমস্যাও রয়েছে। তার মধ্যে কাঁচামালের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি এ শিল্পের জন্য বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে অবৈধভাবে আসা ভারতীয় শাড়ির দাপটে দেশি উন্নতমানের বেনারসি শাড়ি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
সুতাসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ফলে বেনারসি উন্নতমানের শাড়ি হওয়ার পরও কেবলমাত্র ভারতীয় সস্তা দামের শাড়ির কারণে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
এছাড়া এখানকার রাস্তাও এ শিল্পের জন্য আরেকটি সমস্যা। শুকনো মৌসুমে মেঠো পথে ধুলোয় মেখে কোনোভাবে যাওয়া গেলেও বর্ষা মৌসুমে এই পল্লীতে যাতায়াত করা অত্যন্ত কষ্টকর। আর এই কষ্টের মাঝেই নিয়মিত এখানকার মানুষগুলো যাতায়াত করে থাকেন।
মঙ্গলবার (৭ জুলাই) বেনারসি শাড়ি তৈরি পল্লীর ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সঙ্গে কথা হলে এমনই তথ্য উঠে আসে।
বগুড়া জেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বেনারসি পল্লী ঘোলাগাড়ি কলোনির অবস্থান। অবশ্য কেউ কেউ এ কলোনিকে ঘোলাগাড়ি গ্রাম বলেও ডাকেন। তবে আসলে কলোনি বা গ্রামটি বেনারসি পল্লী নামেই বেশি পরিচিত।
সেই ১৯৪৭ সালের কথা। দেশ বিভাগের পর ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আব্দুল ওয়াহেদের পরিবারের পূর্বপুরুষরা অনেকের মতো ঘোলাগাড়ি কলোনিতে চলে আসেন। পরে পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এই আব্দুল ওয়াহেদ বাংলানিউজকে জানান, ১৯৮০ সালে ঘোলাগাড়ি কলোনিতে তিনি প্রথম তাঁতের কাজ শুরু করেন। বেনারসি শাড়ি তৈরির জন্য তিনি ঢাকা থেকে দু’টি তাঁত মেশিন কেনেন। তিন ধাপে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা গড়ে তুলতে সে সময় তার প্রায় ২০-২২ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। এরপর ঢাকা থেকে সুতা, জড়ি, কেলা, তানি, রং এনে শুরু করেন বেনারসি তৈরির কাজ।
আব্দুল আহাদ, জাহেদ আলী, আবু সাঈদ, খোরশেদ আলমসহ একাধিক তাঁতশিল্পী বাংলানিউজকে জানান, এখন কথা বলার ফুসরত নেই। ঈদের অর্ডারের কাজ করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বড্ড ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
এই ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতায় তারা জানান, তখনকার দিকে একেকটি শাড়ি তৈরিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লেগে যেত। কিন্তু এখন সেই আগের সময় নেই। কারণ তাদের কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ লেগেছে। এখন এই পল্লীর কারিগররা বিদ্যুতের আলোয় কাজ করেন। তিনজন কারিগরের সমন্বয়ে একেকটি পুর্ণাঙ্গ শাড়ি তৈরি করা হয়।
এদিকে ১৯৯০ সালের পর থেকে বেনারসি শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে শুরু করে। একটি সময় এসে গ্রামের সব পরিবারই অন্য পেশার পাশাপাশি এ পেশাকে প্রধান পেশা ধরে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। গ্রামের প্রতিটি পরিবারের নারীরাও কমবেশি এ পেশার সঙ্গে যুক্ত।
রুমি খাতুন, সালমা আক্তার, জাহানারা বেগমসহ কয়েকজন নারী কারিগর বাংলানিউজকে জানান, অভাবের সংসারে সবাই মিলে পরিশ্রম করলে আয় বাড়ে। এতে অভাব অনেকটা কেটে যায়। তাই স্বামীর সঙ্গে তারাও নিজেকে এ পেশায় নিয়োজিত করেছেন।
তারা জানান, এই পল্লীতে বেনারসি বুটিক, জামদানি, ব্রকেট, টাইটাকি পারআঁচল, কাতান, কাতান বুটিক, পাটি নামের বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে।
পাইকারি দর হিসেবে প্রতিটি বেনারসি বুটিক ২০০০-২৫০০ টাকা, জামদানি ৪০০০-৪৫০০ টাকা, ব্রকেট ৩৫০০-৪০০০ টাকা, টাইটানিক ১২০০-২৫০০ টাকা, পারআঁচল ১৬০০-১৮০০ টাকা, কাতান ৪০০০-৪৫০০ টাকা, কাতান বুটিক ৩৫০০-৪০০০ টাকা ও পাটি ৫০০০-৫৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে রেশমি সুতোয় তৈরি একেকটি শাড়ির দাম পড়ে ৯০০০০-১০০০০ টাকা।
ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ীরা হলেন ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তৈরি বেনারসি শাড়ির প্রধান ক্রেতা। এছাড়া রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় এসব শাড়ি বিক্রি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ০২০৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০১৫
এমবিএইচ/এএসআর