রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: ‘চার-পাঁচটি বন্দুক ঘরে থাকে। এর একটিও খোয়া গেলে চাকরি থাকবে না! ঘরের যা অবস্থা, হ্যাঁচকা টান দিলে দরজা-জানলা খুলে আসবে।
কালেঙ্গা রেঞ্জ অফিসে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল ফরেস্ট রেঞ্জার শেখ আ. কাদিরের সঙ্গে। মাঝখানে প্রাসঙ্গিক মনে করে শুরুর আক্ষেপটি জুড়ে দিলেন বিট অফিসার মাহবুব হোসেন।
রেঞ্জার সাহেবের কথাই চলুক, আমি দীর্ঘদিন সুন্দরবনে দায়িত্ব পালন করেছি। রেমা-কালেঙ্গায় যেসব অমূল্য গাছ রয়েছে তা সুন্দরবন কেন, দেশের অন্য কোনো বনেই নেই! এখানে কোটি কোটি টাকার গাছ রয়েছে। মাত্র ৩৩ জন ১৪ হাজার ২৮১ একরের বন পাহারা দিই। অথচ আমাদেরই কোনো নিরাপত্তা নেই!
বলে চলেছেন তিনি, পাচারকারীরা গাছ কাটতে ২৫ থেকে ৩০ জনের দল নিয়ে আসে। তাদের ঠেকাতে আমরা যাই মাত্র তিন থেকে চারজন। ওই গহীন বনে আমাদের মেরে রেখে দিলেও কেউ খোঁজ পাবে না।
পাচারকারীরা আবার নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়। দেখা যায়, বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে (ডিএফও) ফোন করে কেউ বলল, বনের অমুক অংশে গাছ কাটা হচ্ছে। ডিএফও সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন ঘটনাস্থলে যেতে। গিয়ে দেখা যায়, গোটা বিষয়টি আসলে ধাপ্পাবাজি। গাছ কাটা হচ্ছে অন্য কোনো জায়গায়। বনের ভিতর তো হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সব শেষ, যোগ করেন আ. কাদির।
কথায় কথায় রাত বাড়ছে। এর মধ্যে দুইদফা চা-টা হয়ে গেল।
বাংলানিউজ টিমকে পেয়ে যেন বহুদিনের জমানো আক্ষেপগুলোই উগরে দিলেন আ. কাদির, এতবড় বন হাতে গোনা কয়েকজন দিন-রাত পাহারা দিয়ে রাখি। তারপরও যদি গাছ কাটা যায়, জরিমানা হবে আমাদের। চাকরিও চলে যেতে পারে!
দিন-রাত পাহারা প্রসঙ্গে বললেন, সাধারণত অফ টাইম অর্থাৎ জুমার নামাজ, শেষ রাত বা এখন রোজার মাসে সেহরি ও ইফতারির সময় গাছ কাটতে আসে। ঈদের দিনও বাদ যায় না। আর আমাদেরও কোনো সময়-অসময় নেই, বনকে ভালোবেসে ছুটে যাই। আমাদেরও যে আর পাঁচটি মানুষের মতো একটি জীবন রয়েছে, এটি কেউ বুঝতে চায় না।
রেঞ্জার সাহেব চায়ে চুমুক দিতেই সুযোগ পেলেন বিট অফিসার মাহবুব, এই যে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন পাহারা দিই, এজন্য কোনো ঝুঁকি ভাতা নেই। প্রায় সময় আমরা মারাত্মক আহত হই। চিকিৎসার খরচ নিজের পকেট থেকেই যায়। আর গাছ কাটা ঠেকাতে যাওয়াটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, আমরা তাদের ধরতে পারলে তারা জেলে যাবে, না ধরতে পারলে তাদের লাভ।
‘গুলিতে মারাও পড়তে পারে’।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন ফরেস্ট রেঞ্জার।
উপরের বক্তব্য ধরেই বললেন, রিজার্ভ এলাকায় কাউকে আটক করতে কোনো ওয়ারেন্ট বা গুলি চালাতে কারও অনুমতি লাগে না। অর্থাৎ বন রক্ষার্থে আমি যে কারও ওপর গুলি চালাতে পারি। তার মানে, ধরা পড়া বা গুলি খাওয়া থেকে বাঁচতে পাচারকারীরা যেকোনো কিছু করতে পারে। ঠিক এখানেই আমাদের ঝুঁকি।
দরকার আরও প্রশিক্ষিত তরুণ জনবল। আমাদের থাকার জায়গাগুলো আরও নিরাপদ করতে হবে। আমরা সবটুকু উজাড় করে বন পাহারা দিই। আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও তো দেখতে হবে, বললেন আ. কাদির।
বিট অফিসারের আক্ষেপ দিয়ে লেখা শুরু হয়েছিল। এর আরও বিস্তারিত থাকবে আগামী পর্বে।
আপাতত এ বিষয়গুলো নিয়েই কথা হয় বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সিলেট) দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে।
বললেন, তাদের মহার্ঘ্য ভাতার জন্য উপর মহলে আবেদন ও সুপারিশ করা হয়েছে। বাকি বিষয়গুলো নিয়েও ভাবা হচ্ছে। আশাকরি, শিগগিরই এর সুফল পাবেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০১৫
এসএস
** পাহাড়ের ভাঁজে অরণ্যের দিনরাত্রি
** ৩৩ জনের কাঁধে দেশের ২য় বৃহত্তম বন
** সৌরবিদ্যুতে আলোকিত বনাঞ্চল
** যে রাস্তায় অটোরিকশা হয়ে যায় সিন্দাবাদের জাহাজ!
** পাখির ডাকে রাত, পাখির ডাকে দিন
** বন্যপ্রাণীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়াশ্রম