ঢাকা: বছরব্যাপী টমেটোর চাহিদা থাকলেও এক সময় আবহাওয়ার কারণে শুধু শীতকালেই এ সবজি চাষ হতো। কিন্তু কৃষি বিজ্ঞানীদের সফলতায় এখন ১২ মাসই টমেটোর চাষ হচ্ছে।
১২ মাস চাষ হওয়ায় সবজিটির উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি ভোক্তাদের চাহিদা যেমন মিটছে, তেমনি বদলে যাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য। গ্রীষ্মকালে টমেটোর চাষ করে নামের পাশে স্বাবলম্বী শব্দটি যোগ করতে পারছেন টমোটো চাষীরা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাষী ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের এ সফলতার গল্প।
যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানার বলরামপুর গ্রামের টমেটো চাষী চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে তিন সন্তানকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনেছেন।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, যখন এক মৌসুমী টমেটো চাষ করতেন তখন তার সংসারে টানাটানি লেগেই থাকতো। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে ভাগ্য খুলে যায়। এক ছেলে ও দুই মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এসবই সম্ভব হয়েছে টমেটো চাষের আয় থেকে।
তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালীন টমেটো প্রথম দিকে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারতাম। এছাড়া সব সময়ই এ টমেটোর চাহিদা থাকায় ভালো দাম পাওয়া যায়। আমাদের গ্রামের অনেকেই এই টমেটো চাষে ভালো আয় করছেন। এক শতক জমিতে খরচ হয় প্রায় সাত হাজার টাকা। যা বিক্রি করা যায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায়।
তবে এ টমেটোর সফলতা এক দিনে ধরা দেয়নি। দীর্ঘ কয়েক বছরের পরিশ্রম আর মেধার সমন্বয়ে সফলতা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র সূত্র জানায়, এ কেন্দ্রের সবজি বিভাগের বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯৯৬ সালে প্রথম উচ্চতাপ সহিষ্ণু বারি টমেটো-৪ ও বারি টমেটো-৫ নামে দু’টি জাত অবমুক্ত হয়।
এ দু’টি জাতের টমেটোতে লাভজনক ফলনের জন্য কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগের প্রয়োজন হতো। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা ১৯৯৮ সালে হরমোন প্রয়োগ ছাড়াই লাভজনক ফলন দিতে সক্ষম এমন দু’টি হাইব্রিড জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো {বারি টমেটো-১০ (অনুপমা) ও বারি টমেটো-১৩ (শ্রাবণী)} উদ্ভাবন করেন। কিন্তু এই দু’টি হাইব্রিড জাতের টমেটোর
আকার খুবই ছোট (গড়ে ২৫ গ্রাম) হয়।
সবশেষে উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল বারি হাইব্রিড টমেটো-৩ ও বারি হাইব্রিড টমেটো-৪ নামের দু’টি জাত আবিষ্কার করেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। এরপর বানিজ্যিকভাবে লাভজনক ফলন পেতে থাকেন টমেটো চাষীরা।
এছাড়া সম্প্রতি গ্রীষ্মকালে চাষোপযোগী বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ নামে আরও একটি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। যা টমেটোর আগের জাতগুলোর তুলনায় আকারে বড় ও ফলন বেশি। বর্তমানে বারি -৩, ৪ ও ৮ এই তিন জাতের টমেটো চাষ করছেন চাষীরা।
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর বিভিন্ন জাত নিয়ে শুরু থেকে কাজ করছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের সবজি বিভাগের বিজ্ঞানী ড. নাজিম উদ্দিন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড টমেটো খুবই সম্ভবনাময় অর্থকরী ফসল। স্বল্প সময়ে উচ্চমূল্যে পাওয়ায় এ টমেটো চাষে অনেক কৃষকের জীবনমান বদলে গেছে। এ টমেটো চাষ করে এক মৌসুমে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
তিনি বলেন, প্রথমে উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও বিজ্ঞানী ড. শাহবুদ্দিন আহম্মেদ গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড টমেটো নিয়ে কাজ শুরু করেন। এরপর তার সঙ্গে আমিও যোগ দিই।
সবশেষে এই কৃষি বিজ্ঞানী জানান, বর্তমানে এসব টমেটো চাষ করতে গিয়ে কিছু ভাইরাস রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। তবে আশার কথা হলো, এ বছর শেষে ভাইরাস প্রতিরোধী গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাত চাষী পর্যায়ে উন্মুক্ত করা হবে। ফলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে এই গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ সম্ভব। দিনদিন এ টমেটো চাষের জমি ও উৎপাদনের পরিমান বাড়ছে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ২২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ৪৭৫ মেট্রিক টন গ্রীষ্মকালীন টমেটো। আর সবশেষে ২০১৪ সালে তা বেড়ে ৩৭৫ হেক্টর জমিতে সাড়ে সাত হাজার মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদিত হয়েছে।
তবে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে গিয়ে বেশকিছু সমস্যার মধ্যে পড়ছেন চাষীরা। প্রায় ১২ বছর ধরে এ হাইব্রিড টমেটো চাষ করছেন যশোর জেলার কৃষক জালাল উদ্দিন।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, একই জমিতে এ টমেটো একাধিকবার চাষ করায় জমির মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে টমেটো সংরক্ষণ করতে গিয়েও চাষীদের বেশ সমস্যা হয়। এছাড়া মাঝেমধ্যে বীজ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় তাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০৩ ঘণ্টা, ১২ জুলাই, ২০১৫
একে/আরএম