শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): গাছটির শরীরে ফলের সমাহার! একটি-দুটি নয়! থোকায় থোকায়, শত শত! লাউয়াছড়ার খাসিয়াপুঞ্জিতে গিয়ে হঠাৎ দেখা তার সঙ্গে। ছবি ধারণ করে, রূপ দর্শন করে টিলা বেয়ে নিচে নেমে আসার সময় হঠাৎ মনে হলো, প্রকৃতির মায়ায় বেড়ে ওঠা সবুজ বন, বানরের দল ছুটে এসে টানছে লটকন!
বাংলার ফলসম্ভারের মধ্যে বিশেষ একটি ফল লটকন।
প্রকৃতির নিবিড় এক সৌন্দর্যকে তুলে ধরে গাছের ডাল আর শাখায় ঝুলছে থোকায় থোকায় লটকন। একসময় জংলি ফল বলে লটকনের অপপ্রচার ছিল ব্যাপক। তবে অপ্রচলিত ফল হলেও সে এখন বর্ষার ফল হিসেবে নিজের নামটি সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের দেওয়া স্থানীয় নামেও রয়েছে তার পরিচিতি। বৃহত্তর সিলেটবাসী ‘বুবি’ বা ‘ডুবি’ নামে চেনে তাকে। চট্টগ্রামে এর নাম ‘হাড়ফাটা’। আবার ময়মনসিংহে এদের বলে ‘কানাইজু’। এছাড়াও ‘লটকা’, ‘লটকাউ’, ‘কিছুয়ান’- এসব নামেও ফলটি আঞ্চলিকতার মায়াজলে বাঁধা রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, টক-মিষ্টি স্বাদের লটকন আমাদের দেশি ফল। লটকন গাছের কাণ্ড থেকে মাথা পর্যন্ত ফল ধরে। এটি খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশীয় বৃক্ষ। আমাদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এ বৃক্ষটিকে তালিকাভুক্ত করে এর ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব। কারণ এটি একদিকে মানুষেরও খাদ্য আবার বন্যপ্রাণিরাও ফলটি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বসন্তে গাছে ফুল ধরে। বর্ষার মধ্যে পাকতে শুরু করে ফলগুলো। জুলাই-আগস্ট মাসে ফলটি পরিপক্কতা অর্জন করে বাজারে আসে। কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পাকা অবস্থায় হলুদ হয়ে থাকে। ফলটি বৃত্তের মতো গোলাকার। ফলের ভেতরের শাঁস বা কোষটি রসালো, নরম ও মিষ্টি ঘ্রাণযুক্ত। অম্লমধুর অর্থাৎ, টক-মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে বলে খেতে তৃপ্তিদায়ক। ফলের খোসা নরম ও পুরু। লটকনের মোটা খোসা নখ দিয়ে ছিঁড়লেই দেখা মেলে গাদাগাদি করে থাকা তিন থেকে চারটি কোষ বা বীজ। গাছপাকা লটকন খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু।
ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন ফলটির পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বলেন, টক-মিষ্টি স্বাদযুক্ত লটকন খাদ্যমানের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে খাদ্যশক্তি রয়েছে ৯১ কিলোক্যালরি। যা আমলকির প্রায় পাঁচগুণ। এছাড়াও আমিষ রয়েছে ১ দশমিক ৪২ গ্রাম, স্নেহ শূন্য দশমিক ৪৫ গ্রাম, খনিজপদার্থ শূন্য দশমিক ৯ গ্রাম, ভিটামিন বি-১ শূন্য দশমিক ০৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ শূন্য দশমিক ১৯ মিলিগ্রাম, লৌহ শূন্য দশমিক ৩ মিলিগ্রামসহ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সিও।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, উৎপাদনের পরিমাণ বেশি না হলেও দেশের সব এলাকাতেই এটি কম-বেশি চাষ হয়ে থাকে। ফলটির চাষও লাভজনক। নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা, সিলেট প্রভৃতি এলাকায় ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে। বাজারে লটকনের খুচরা মূল্য ৬০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। এক কেজিতে আকারভেদে ২৫ থেকে ৭০টি পর্যন্ত হয়। একটানা ১৮-২০ বৎসরের গাছে সর্বোচ্চ ফলন থাকে।
লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির শিলা পাতমি বলেন, পাঁচ বছর আগে এ লটকন গাছ লাগিয়েছি। নিজে খাই ও বিক্রি করি। প্রতিটা ফলের দাম পড়ে এক টাকা। বর্ষার সময় যখন ফল ধরে খুব ভালো লাগে নিজের গাছের ফলগুলো দেখতে।
শিলা আরও বলেন, লটকন খেলে বমির ভাব কমে এবং খাবারে রুচি অনেকখানি বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৫
বিবিবি/এএ