রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: দেখতে দেখতে বনবিভাগে ১৯ বছর পার করে দিলেন মাহবুব হোসেন। বছর খানেক ধরে দায়িত্ব পালন করছেন কালেঙ্গা বিট অফিসার হিসেবে।
কালেঙ্গা থাকতে এসব নিয়ে বিস্তর কথা হয়। ফিরে এসেও কথা হলো সম্প্রতি।
ঈদ তো এসেই পড়লো, বাড়ি যাচ্ছেন তো?
‘সব তো নিজের চোখে দেখে গেছেন। গত দুই ঈদে বাড়ি যাইনি। ভেবেছিলাম এবার যাবো। বাড়ি থেকেও ফোনের পর ফোন আসছে। এজন্য আগে-ভাগেই চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এখন ন্যূনতম সম্ভাবনাও নেই। কর্তৃপক্ষ খুব শক্তভাবে আটকে দিয়েছে। কতদিন যে ছেলেমেয়ের মুখ দেখি না!’
ঈদ-পার্বণ এলেই বাড়িয়ে দিতে হয় বনের নিরাপত্তা। কারণ, এসময়গুলোতেই গাছপাচারকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। অন্যসময়ও যে খুব ভালো যায় তা নয়। ১৪ হাজার ২৮১ একরের বন মাত্র ৩৩ জনে পাহারা দিতে রীতিমতো হিমশিম খাওয়ার দশা। তাই সারাবছরই মাহবুব হোসেনদের এ জাতীয় হাহাকারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
‘চার-পাঁচ মাস পরপর দু-তিনদিনের জন্য বাড়ি যেতে পারি। তাও ফরেস্ট রেঞ্জারের কাছ থেকে মৌখিক ছুটি নিয়ে। এর মধ্যে কোনো গাছ কাটা গেলে রক্ষে নেই। জরিমানা তো গুনতেই হবে, চাকরিও চলে যেতে পারে। আর ছুটি নিয়ে কার ভরসায় রেখে যাব, লোকই তো নেই। ’
পরিবার নিয়ে যে সেখানে থাকবেন সে উপায়ও নেই। কাছাকাছি নেই কোনো ভালো স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, দোকানপাটসহ জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সুলভ ব্যবস্থা। বন রক্ষকদের থাকার জায়গাগুলোরই বেহাল দশা। ১৯৬১ সালের পর না কোনো নতুন ভবন হয়েছে, না হয়েছে যেগুলো ছিল সেগুলোর উন্নয়ন। কথায় কথায় তথ্যটি দিয়েছিলেন ফরেস্ট গার্ড শামসুল আলম মজুমদার।
চোখে-মুখে এমন আকুতি নিয়ে বলছিলেন, যেন বাংলানিউজকে বললেই সব সমস্যা মিটে যাবে, ‘নিজেরাই যেখানে এত কষ্ট করে থাকি, সেখানে পরিবার এনে কী করে রাখবো! এখানে থাকা-খাওয়া ও স্যানিটেশনের খুব সমস্যা। ঘরের দরজা-জানলাগুলো দেখেন, মনে হবে যেকোনো সময় খুলে আসবে। দু-তিনদিনের জন্যও বেড়াতে আসার উপায় নেই। ’
গোটা বন রেমা, কালেঙ্গা, ছনবাড়ি ও রশিদপুর- এ ৪টি বিটে ভাগ করা। প্রত্যেক বিটে বনবিভাগের নাজুক দু-একটি বাড়িতে বনরক্ষকরা থাকেন। ফরেস্ট রেঞ্জার একটি আলাদা বাড়িতে থাকলেও, বাকিরা থাকেন মেস মতো করে। মেসের মতোই থাকা-খাওয়া। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।
মাহবুব হোসেন যাকে বলেন বনবাস। ‘সত্যিকারের বনবাস বলতে গেলে যা বোঝায়, এটি তাই। পরিবার-পরিজন থেকে সবরকমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকি। তার ওপর দিন-রাত ডিউটি করতে করতে এমন দশা, ঠিকমতো বাড়ির খোঁজ-খবরও নিতে পারি না। বাড়িতে কেউ মরে গেল না বেঁচে রইল তার চেয়েও বড় টেনশন, কোথাও গাছ কাটা গেল কিনা। ’
এসব নিয়ে পরিবারের অভিযোগ নেই? ‘নেই আবার! তার কী আর শেষ আছে। আমাদের সংসার জীবন বিপন্ন। এসব বলতে গেলে বা ভাবলেও কান্না আসে। ’
কান্না ঠেকানোর জন্যই বোধহয় ধরিয়ে দিলেন ছনবাড়ির বিট অফিসার রইস উদ্দিনকে।
মাহবুবের আগে বনবিভাগে ঢুকেছেন রইস। চাকরির বয়স প্রায় ২৫ বছর। ছনবাড়ির দায়িত্বে রয়েছেন গত ছয় বছর ধরে। জয়পুরহাটের বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধ মা, দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী।
কী আর বলবো বলতে বলতে বললেন, আমাদের সবার গল্পই আসলে এক। সবার সমস্যাগুলোও একই রকম তাই সমাধানও একই। শুধু আমাদের প্রতি নয়, সমগ্র বন বিভাগের প্রতিই সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
ফরেস্ট রেঞ্জার শেখ আ. কাদিরের আবার মিশ্র প্রতিক্রিয়া, সয়ে গেছে বুঝলেন! চাকরির আর বছর দুয়েক রয়েছে। কদিন পরই অবসরে যাবো। তাও চেষ্টা করে যাচ্ছি। উপর মহলের কাছে বিষয়গুলো বারবার তুলে ধরছি। আমি হয়তো এইসব সুবিধা পাবো না, কিন্তু অন্যরা তো পাবেন।
কথা হলো আ. কাদিরের উপর মহল অর্থাৎ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে।
তারা যেভাবে মানবেতর অবস্থানে থেকে দেশের সেবা করেন, এর মূল্য কোনোভাবেই দেওয়া সম্ভব নয়। তাদের বাসাবাড়ির উন্নয়ন, মহার্ঘ্যভাতাসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো পরিকল্পনা কমিটির কাছে তোলা হয়েছে। সেখানেও নানা ধাপ রয়েছে। আশাকরি, দ্রুতই বিষয়গুলোর সমাধান হবে বলে জানালেন ডিএফও।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৫
এসএস/জেডএম