ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৫
এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা! ছবি: দীপু মালাকার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

স্বরূপকাঠি-ভীমরুলী (পিরোজপুর-ঝালকাঠি) ঘুরে: ছোট্ট একটি খাল। সেই খাল ধরে ডিঙি-নৌকায় যাচ্ছেন আপনি।

দুই পাশের ডাঙায় যেন সবুজ স্বর্গ। কিছু সময় বাদে-বাদে পুটি মাছের লাফালাফি আর পাখিদের কিচিরমিচির। খালের কিনারে চোখ মেলছে গিরগিটি।

আঁকাবাঁকা খালে আরো কিছু দূর ডিঙি বাইতেই দু’পাশে শুধু পেয়ারার গাছ আর গাছ। গাছগুলোতে পাতা যতো, ফলও ততো! স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ), কুড়িয়ানা, আটঘর, আদমকাঠি পার করে ভীমরুলীর পরিবেশ-প্রতিবেশ এমনই।

এক খালপাড়েই অপার সৌন্দর্য্য। এ সৌন্দর্য্য পেয়ারা রাজ্যের। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি দিয়ে এগিয়ে যেতেই কিছু সময়ের মধ্যে চোখে পড়তে শুরু করবে এসব পেয়ারার বাগান। সোজা পথে একদম ঝালকাঠির ভীমরুলী পর্যন্ত এমন রূপময়তা। তারপর আবার জলে ভাসা পেয়ারা বাজারও রয়েছে আড়তগুলোতে। সেখানে কী এক জমজমাট পরিস্থিতি!

স্বরূপকাঠি কিংবা ঝালকাঠি দিয়ে এলে- বাসস্ট্যান্ডে নেমেই সে গুণগান শ্রব্য হবে। চারদিকে কেবলই বাগান। মধ্য বাগানে চোখ মেলে দেখে; ডালে ঝোলা পেয়ারা নিজের হাতে পেড়েই সেকেন্ডের মধ্যে কামড়...। মনে আসতে বাধ্য- এ পেয়ারার স্বাদ ও মজাই আলাদা! একদম টাটকা, কোনো প্রকার পোকার আক্রমণ নেই। পোকা পেয়ারাতে কেন, পুরো বাগানেই নেই। নেই কোনো দূষণ। টলটলে পানিতে হালকা সবুজ বর্ণের পেয়ারা ধুয়ে কামড়ালেও ক্ষতি নেই জানালেন চাষী কার্তিক বড়াল (৪০)।

তখন আদমকাঠিতে, পেয়ারা বাগান চোখে পড়তে শুরু করেছে তার আগের ইউনিয়ন কুড়িয়ানা, আটঘর থেকেই। কার্তিক নামের ওই ব্যক্তি লুঙ্গি পরা, খালি বদন। দূর থেকে তাকে আন্দাজ করা মুশকিল। তবে কাছে যেতেই কাজে মশগুল সে ব্যক্তির সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ। বাঁশে আংটা পেঁচিয়ে পেয়ারা পাড়তে পাড়তে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এহন কোথথেইকা, এতো সহালে দাদা?

প্রশ্ন-উত্তরের পর্ব শেষে জানা গেলো, তিনি মূলত চাষী। সারা বছর টুকটাক কাজ করেন আর পেয়ারার মৌসুমে চার মাস বাগানে ভোর রাত থেকে বিকেল পর্যন্ত সময় দেন। কার্তিকের ভাষায়, হপায় সকাল ৭টা, আরও দেইর ঘণ্টা গোইয়া পাইড়া যামু ভীমরুলীতে। বেচপার কুড়িয়ানাও যাই, ওইহানেও যাই। তয় ফরাক তেমন কিছু নয়, একই। ভীমোর তো বড়, আইজ গোইয়া কচ-কচ তাই যাইবোআনে...।

তার বাগানের পেয়ারা খেতে কী মজা, এর জুড়ি সারাজীবনে মিলবে না! অন্তত এখানকার পেয়ারা আগে মুখে না পুরে থাকলে। শুধু তার বাগানই নয়, আশপাশের সব বাগানের চিত্র যেমন এক, স্বাদ-ঘ্রাণও তেমনই।

ভরা মৌসুমে অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণে ৭-৮ জন কর্মী বাহিনী ছিল তার। এখন তিনি একা। ওই সময় এতো পেয়ারা ধরতো যে কূল করা যেতো না। এখন তো পড়তি মৌসুম। গাছে ফল কম।

পেয়ারা চাষী কার্তিক জানান, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ভালোই আছেন। মেয়ে দেড় বছর বয়স, আর ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। পেয়ারাই আসলে তার জীবন ঘুরিয়েছে বলে আশার কথা শোনান তিনি।

আরও বলেন, সরকার যদি আমগোরে একটু দেখতো, তয় লস খাইতাম না ভরা মৌসুমে। কিছুই না, সরকার শুরু আমগোর পেয়ারা নিক, হেরপর নিজেই বেচুক। তয় না হয় বেচপার ব্যবস্থা কইরা দিক। বড় বড় শহরে বেচপার গতি কইরা দেক।

এতোটুকুই এ প্রত্যন্ত গ্রামের কার্তিকের দাবি। তার পাশের বাগানি জগদিশ চন্দ্র হালদার (৬০)। পেয়ারা পাড়ছিলেন, হাটে নেবেন। বয়স বেশি, কিন্তু দেখে মনে হওয়ার সুযোগ কম। প্রথমেই তাকে এই প্রশ্ন। উত্তর, পেয়ারা খাইতে খাইতে ছোটথেন বড় হইসি। এক পেয়ারায় চাইর-পাঁচ আপেল গুণ। তয় কোনডা নিয়ম কইরা খাবেন ভাইবেন।

সরল-অমায়িক মানুষ। তার আক্ষেপ শহরবাসীও আর পেয়ারা খান না। তবে এও স্বীকার করলেন, এমন ভালো পেয়ারা সেখানে যায়ও না। যদি এখানকার উৎপাদিত পেয়ারার একটা বড় অংশ এখানেই থেকে যায়- তবে মঙ্গল কারোই নয়, মত দেন জগদিশ।

প্রতি বাগানের ভেতরে চ্যানেল আকারে খাল করা। জ্যৈষ্ঠ মাসে বাগানের এসব খাল নাব্য করতে হয়, যেন ডিঙি বেয়ে ঢোকা যায়। আর পেয়ারা গাছের গোড়ার মাটি উঁচু। খালের একটি অংশের মুখ মূল খালের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এতে কাজ শেষে সেখান থেকে বেয়ে-বেয়ে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

ডিঙি নিয়ে ফনী হালদারও (৫৮) পেয়ারা পাড়ছিলেন। নিজের জমি নয়, বিঘা বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন ৩০ হাজার টাকায়। এছাড়া গাছের যত্ন, চার মাসের টানা শ্রম তো রয়েছেই। সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে এখনও তিনি লাভের মুখ দেখেননি, সময়ও হাতে কম।

তিনিও দুঃখ করে বলেন, এতো সুস্বাদু পেয়ারা তবে কত জনে জানে। যুগ আধুনিক, কিন্তু এই চাষীদের চারদিক সম্পর্কে অনেকেই অজানা। ফনী বলেন, আইপনারা আইছেন, মূল্যায়ন দিছেন, কথা শুনছেন অনেক ধন্যবাদ। আপনাগো লেখা দেইখা সরকার যদি কিছু করে আমগো লাইগা, এই চাওয়া।

আর একটু এগিয়ে যেতেই ঝালকাঠি জেলা, ভীমরুলী। পরিমল সমাদ্দার (৪৫) বাগান থেকে পেয়ারা পেড়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন মূল হাটে (ভীমরুলী ভাসমান হাট)। বিঘা দুই  জমিতে ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত পেয়ারা পেড়ে তিন মণ সংগ্রহ হয়েছে। ভরা মৌসুমে যা পাঁচ-ছয় মণ হয়ে যেত।

বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারার রাজ্য এই অঞ্চল। তবে নানাবিধ সমস্যার কারণে তেমন অগ্রসর হতে পারছে না এ এলাকার ৩১ হাজার একরেরও বেশি জমির পেয়ারা চাষ। ফলে বিপাক কেবল চাষীদেরই নয়, ব্যবসায়ী-আড়তদারদেরও, এমনই মত স্থানীয় মো. আলমগীর হোসেনের। বাড়ি এখানেই। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ী তিনি। সরাসরি পেয়ারা কিনে নিয়ে যান, স্বরূপকাঠি কুড়িয়ানা রুট দিয়ে। ভীমরুলী ভাসমান হাটের আধা কিলো আগে তার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। ট্রলারযোগে যাচ্ছিলেন দল-বল দিয়ে। বললেন, এ পেয়ারার স্বাদই আলাদা! ঢাকায় পৌঁছানোই তো কষ্টকর। তাই পিছিয়ে আছি। রাজধানীর মানুষ তো এসব পেয়ারা গাছ থেকে পাড়বার ৪-৫ দিন পরে পান, তাতে কি আর সরাসরি বাগানের স্বাদ-মজা-ঘ্রাণ থাকে!

পেয়ারার পুষ্টিগুণ:
খনিজ উপাদানে ভরপুর ও ভিটামিন সি (২১১ মি.গ্রা.) রয়েছে এই ফলে। স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করা যায় পেয়ারা খেয়ে। এছাড়া মুখগহব্বর, দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখে পেয়ারা। এতে রয়েছে ক্যারোটিন ও নানা রকম খনিজ। ক্যারোটিন শরীরে ভিটামিন এ’র কাজ করে। স্বল্প মূল্যে ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করতে নিয়মিত পেয়ারা খাওয়ার পরামর্শ পুষ্টিবিদদের।

প্রতি ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ০.২১ মি.গ্রাম ভিটামিন বি-১ ও ০.০৯ মি.গ্রাম বি-২ পাওয়া যায়। এসব ভিটামিনের অভাবে বেরিবেরি ও মুখের ঘা জনিত নানারকম অসুখ হতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ৭৬ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি আছে। ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ১.৪ গ্রাম প্রোটিন ও ১.১ গ্রাম স্নেহ পাওয়া যায়।

প্রতি ১০০ গ্রাম পেয়ারায় আরও মেলে ১৫.২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট। যা শরীরের আভ্যন্তরীণ কার্যকলাপে সাহায্য করে। তাছাড়া ফলের পেকটিন ও সেলুলোজ রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ০.৬ গ্রাম মিনারেল, ০.০৩  মি.গ্রাম থায়ামিন, ০.০৩ রিবোফ্লেভিন ১.৪ মি.গ্রাম আয়রন, ২৮ মি.গ্রাম ফসফরাস ও ২০ মি.গ্রাম ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৫
আইএ/জেডএম

** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।