ঢাকা: হাইস্কুলে পড়ার সময় ইউটিউবে নিজের একটি ভিডিও খুঁজে পান। বুঝতে বাকি ছিল না কেউ অজান্তে তার ইউটিউবে পোস্ট করেছে ভিডিওটি।
মেয়েটির নাম লিজি ভালাস্কোয়াজ। ছবি দেখে সবাই চিনবেন তাকে। পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিজির ছোটখাটো উক্তি ও তার সম্পর্কে জেনেছেন অনেকেই।
লিজির সঙ্গে সাধারণ মানুষের অবয়বের কোনোভাবেই মিল খোঁজা চলে না। পথে বের হলেই রাজপথের সমস্ত অবসর চোখ ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার সমালোচনা আর উৎপীড়নে।
স্বাভাবিকভাবেই ওজন বাড়ে না লিজির। শরীরে চর্বি তো নেই, যেনো অস্থির উপর চামড়ার প্রলেপ দেওয়া। উচ্চতা পাঁচ ফুট দুই। ওজন মাত্র ২৯ কেজি! রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে নেই বললেই চলে। এক চোখ অন্ধ। লিজির এই শারীরিক গঠন বা বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন হওয়ার নয়। এক বিরল শারীরিক অবস্থা তার এই বাহ্যিক রূপের জন্য দায়ী।
ইউটিউবের সেই ভিডিওর কমেন্টগুলো লিজির জন্য মোটেও সুখদায়ক ছিলো না। কটূক্তি, হাসি-তামাশাপূর্ণ কমেন্টের ওজনে ফিকে হয়ে গিয়েছিলো লিজির মন।
একজন লিখেছিলো, লিজির মায়ের উচিত ছিলো তার জন্মের আগেই গর্ভপাত করে ফেলা। আরেকজন বলেছিলো, মেয়েটির উচিত আত্মহত্যা করা।
কিন্তু লিজি? তিনি কি আদৌ আত্মহত্যা করেছিলেন?
২০১৪ সালে লিজি শতাধিক দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে একটি বক্তৃতা দেন। এটি ছিল বিগত বছরগুলোর সব উৎপীড়ন, সেই কষ্টদায়ক ভিডিওর কমেন্ট ও সেসব হিংস্র মানুষের কথার জবাব, যারা বরাবরই তাকে আত্মহত্যা করার কথা বলেছিলো। যারা বলেছিলো, লিজি তোমার মরে যাওয়াই ভালো!
লিজি জানান, তিনি বিরল এক শারীরিক অবস্থা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনিসহ পৃথিবীতে এমনটি রয়েছে মাত্র দু’জন ব্যক্তির।
এই শারীরিক অবস্থার লক্ষণগুলোর জন্যই আমার ওজন বাড়ছে না। জানান লিজি।
লিজি তার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। জন্মের পর ডাক্তার তার মাকে বলেছিলেন, সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির শরীরে অ্যামোনিয়টিক ফ্লুইড নেই। তাই লিজির চিৎকার করে জন্ম নেওয়াটাই তখন ছিলো আশ্চর্যজনক। ডাক্তার লিজির বাবা-মাকে এটাও বলেছিলেন, তোমাদের মেয়ে কথা বলতে, হামাগুড়ি দিতে, চিন্তা বা নিজে কিছু করতে পারবে বলে আশা কোরো না।
তখন লিজির বাবা-মা ডাক্তারকে বলেন, আমরা আমাদের সন্তানকে দেখতে চাই। তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই। আমাদের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে তাকে গড়ে তুলবো।
২৬ বছর বয়সী লিজি জানান, আমার জীবনে যা কিছু করতে পেরেছি তার সবকিছুর কৃতিত্ব আমার বাবা-মায়ের।
কিন্তু যতোই লিজি বড় হতে লাগলেন তার পারিপার্শ্বিকতা ততোই কঠিন হতে শুরু করলো।
লিজি জানান, রোজ সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য যখন তৈরি হতাম, মনে হতো যদি আমার এই সিনড্রোমটা ঘঁষে মেজে ধুয়ে ফেলা যেতো! তাহলে বুঝি আমার জীবনটা সহজ হতো। আর দশটা শিশুর মতোই দেখতে লাগতো আমাকে।
রোজ প্রার্থনা করতাম, ভাবতাম একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখবো এই আমি আর নেই। স্বাভাবিক সুন্দর এক চেহারা। এমন একটি সকাল, যেখানে কোনো লড়াই নেই। কোনো কটূক্তি নেই। কিন্তু প্রতিদিনই আশাহত হতাম। বলেন লিজি।
হাইস্কুলে ওঠার পর ইউটিউবে পোস্ট হলো নিজের অপ্রত্যাশিত ভিডিও। হয়ে গেলাম বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত নারী! শব্দহীন ভিডিওটিতে পড়লো শত শত কমেন্ট। কেউ তো বলেই বসলো, লিজি পৃথিবীর সুবিধার্থে নিজের মাথায় বন্দুক রাখো আর নিজেকে হত্যা করো।
সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। সবাই তো বলে। চেনা অচেনা সবার মুখেই আমাকে নিয়ে এক উক্তি। একবার ভেবেছিলামও আত্মহত্যার কথা। কিন্তু নিজের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে এলাম। ভাবলাম এসব কথাকে আর পাত্তা দেবো না।
ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলাম আমার জীবন আসলে আমার হাতে। জীবনকে চাইলে আমি সুন্দর বা খারাপ করতে পারি। আমার চোখ খুলে গেলো। বুঝতে পারলাম আমাকে সংজ্ঞায়িত করবে আমার কাজ, আমার অবয়ব নয়।
ভাবলাম, আমার এক চোখে আলো নেই। তবে অন্য চোখে আমি দেখি। হয়তো আমি শারীরিকভাবে ঠিক নেই। কিন্তু আমার চুলগুলো খুব সুন্দর। ধীরে ধীরে বুঝলাম, লোকে আমাকে দানবী বলে। হয়তো আমি তা তাদের বলতে দিচ্ছি বলে!
এবার আমি আমার লক্ষ্য, সাফল্য ও অর্জন তৈরি করবো। আর সেটাই হবে আমার পরিচয়। কাজে লেগে গেলাম। যারা প্রতিনিয়ত আমাকে নেতিবাচক কথা বলেছে তাদের ঐসব নেতিবাচক কথাকেই মই হিসেবে ব্যবহার করে আজ আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছেছি।
আমি নিজেকে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিলাম। খুঁজে নিলাম আমি কী চাই। আমি বই লিখতে চাই, স্নাতক শেষ করতে চাই, সংসার ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
দীর্ঘ আট বছর পর আজ আমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে পারছি। আমার প্রথম স্বপ্ন আমি পূরণ করেছি। বই লিখেছি। দুই সপ্তাহ বাদে আমি আমার তৃতীয় বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দেবো।
সবাই যেখানে বলেছিলো আমি পারবো না। আমি সেই নেতিবাচক কথাগুলোকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তাই সবার উদ্দেশ্যে আমার উক্তি, যারা তোমাদের নিয়ে নেতিবাচক কথা বলে সেসব কথাকে কাজে লাগাও। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি জয় তোমারই হবে।
লিজি এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন গতবছর। এ পর্যন্ত লিজির তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। লিজি বিউটিফুল: দ্য লিজি ভালাস্কোয়াজ স্টোরি, বি বিউটিফুল বি ইউ ও চুজিং হ্যাপিনেস।
চলতি বছরের মার্চে তার ডকুমেন্টারি ‘এ ব্রেভ হার্ট: দ্য লিজি ভালাস্কোয়াজ স্টোরির’ প্রিমিয়ার হয়েছে।
আজ লিজি হয়ে উঠেছেন হাজারো মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস।
লিজি তোমাকে স্বাগতম। তোমার জন্য রইলো অসংখ্য শুভকামনা।
বাংলাদেশ সময়: ০২২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫
এসএমএন/এএ