ভীমরুলী (ঝালকাঠি) থেকে: ভাবলে মনে হতে পারে, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার বাইচ। কিন্তু তা নয়।
কোনো প্রতিযোগ নয়, সময় ধরতে হবে। দেরি হলেই বিধিবাম। আশপাশের অন্য সবার মতো গতি ধরে এগিয়ে চলা। হুট করেই রাজ্যে প্রবেশ। মনে হতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের কোনো নদী-খাল টপকে থাইল্যান্ড কিংবা ভিয়েতনামে এসে পড়া কিনা! এত্ত পেয়ারা...! পেয়ারার রাজ্য! তাও আবার জলে ভেসে ভেসে!
জলেভাসা বাজার চারদিক। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় পণ্য নিয়ে শুরু হলো বিক্রি। পানির ওপর জলজ্যান্ত একটি হাট। নাম ভীমরুলী। জেলা ঝালকাঠি, সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। এই জলবাজারে প্রধান পণ্য পেয়ারা।
সারি সারি নৌকার ওপর সবুজ-হলুদ পেয়ারা। এর ভারেই নৌকাও ডুবেছে অর্ধেকখানিক। হাটুরেদের হাঁকডাকে গম গম পুরো এলাকা। এক কথায় খালের ওপর এ এক আজব-অবাক করা বাজার।
স্থানীয়দের কাছে জানা গেল, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান হাট এটি; যা পুরো বাংলাদেশেই অনন্য। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড়! তাহলে কি আরো আছে এমন বাজার? হ্যাঁ, আছে তো- পাশের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) কুড়িয়ানা, আটঘর, আতা, ঝালকাঠির মাদ্রা। আরো মজার বিষয় হলো, এসবই পিরোজপুর সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে আসা একই খালপাড়ে।
ভীমরুলী জলে ভাসা হাটে পেয়ারাবোঝাই ডিঙি নৌকাগুলো একবার এপাশ, একবার ওপাশ, চাষীদের ভালো দামের আশায় এমন নড়চড়। খালের দু’পাশে আড়ৎ ব্যবসায়ীদের আড়ৎ। তারাই কিনবেন। বাংলাদেশের সিংহভাগ পেয়ারা উৎপাদনকারী অঞ্চলের চাষীরা ডিঙিতে বসে বিকিকিনিতে মগ্ন। ভাদ্র মাস শেষ হতে চলেছে, সঙ্গে পেয়ারার মৌসুমও। তবুও কমতি নেই উৎপাদনের। ফলনের তুলনায় দাম ঠিক বিপরীতভাবে পান চাষীরা। উঠে এলো ক্ষতির কথা। তাও খরচ তোলার আশায় চোখে-মুখে পুলক।
এই যেমন বিমল হালদার (৫০)। পাশের গ্রাম মিরাকাঠি থেকে ছোট নৌকায় নিয়ে এসেছেন পেয়ারা। লিজ নেওয়া বাগান তার। জানালেন, আড়াই বিঘা জমিতে পেয়ারা চাষ। এ বছর ভরা মৌসুমে অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ভীমরুলীতে পেয়ারা বিক্রি করেছেন মণ দরে। এখন মৌসুমের শেষ ভাগে এসে বিক্রি হচ্ছে নৌকাবোঝাই নিয়মে, স্থানীয় ভাষায় ‘ঠিকা’ পদ্ধতিতে। গতদিন এক নৌকা কাঁচা-পাকা সবুজ-হলুদ পেয়ারা বিক্রি করেছেন এক হাজার ২শ টাকায়। এদিন এসে দাম চাচ্ছেন এক হাজার ২শ থেকে এক হাজার ৫শ টাকা। তার কাছে পেয়ারা অনুমানিক দুই মণের মতো।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সিজনের শেষে এহন একটু দাম পাইতে আছি। তয় যহন গোইয়া (পেয়ারা) বেশি হইতো, তহন মণ বেচ্ছি ৫০ টাকা দরে আর লছ খাইছি।
এদিকে, স্বরূপকাঠি উপজেলার আদমকাঠি গ্রাম থেকে পেয়ারা ঝালকাঠির ভীমরুলী ভাসমান হাটে এনেছেন পবিত্র ঢালী (৪৪)। প্রতিদিনই নিয়ে আসেন। নিজের বিঘা চারেক বাগানে উৎপাদিত পেয়ারা ঠিকা নিয়মে বিক্রি করে ফিরছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আড়ৎদার সুবাস হাওলাদার আইজ মোর পেয়ারা কিনছেন। নৌকাভর্তি পেয়ারা এক হাজার ৬শ দরে পাইলাম। দাম দই-চাইশ বেশিই আইসে, কারণ মোর পেয়ারা যে সব কচ কচ কাঁচা। হেইয়া টেকবে বেশি দিন। ঢাহায় দামও মেলা হবে মনে অয়।
স্বরূপকাঠির বেপারী আবদুর রহিমের বড় ট্রলারে পেয়ারাগুলো আলতোভাবে ঢেলে দিলেন অরুণ মজুমদার (২৫)। ভীমরুলী খালের পূবপাশে পাঁচ বিঘা জমির পেয়ারা নৌকাযোগে হাটে আনেন তিনি আরো আগেই। বিক্রি করা পেয়ারাগুলো নিজেই বেপারীর ট্রলারে ঢালতে কাজে হাত লাগিয়েছেন। প্রথমে দাম মনমতো না পেয়ে ছাড়ছিলেন না। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, দাম কমার আশঙ্কায় বিক্রি করে দিলেন। পুরো নৌকার পেয়ারা বেচে দুই হাজার ৩শ টাকা মিললো, হবে হয়ত ৪ মণ।
অরুণ পাশের শতদশকাঠির মনি শঙ্করের জমি লিজ নিয়েছেন জানিয়ে বলেন, পুরো মৌসুমের জন্যই (আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র) পেয়ারা বাগান লইতে অয়। গাছ তো থাহেই। শুধু যত্ন আর ফল পুষ্ট হইলে সময় মতো ভোর ভোর পাড়োন লাগে। হেইয়ার তো আর ছুলকা নাই, তাই পচন ধরে পাকলেই। কাঁচা-কাঁচাই দামে পর্তা।
তিনি আরো বলেন, শুরুর দিকে চেইরজন কর্মী আছিল। তহন গাছে পাতা কম, পেয়ারাই বেশি দেখা যাইতোআনে। সিজন যত পার হইতে আছে, উৎপাদন ততই কমে-কমে, এহন ছোট ভাইরে লইয়া পেয়ারা পাড়ি।
জলে ভাসা এ হাটে ছোট বড় ১০ থেকে ১১টি আড়ৎ রয়েছে। এর মধ্যে লিটন মেম্বারের আড়ৎ, রঞ্জন, নিতাই, পঙ্কজ, অনীল শীল, বাবুল হালদার, সুবাস হালদার, রবি, কালু, খোকন বেপারী অন্যতম।
আড়তে বসে লিটন মেম্বারের সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, পেয়ারা কিনে ঢাকায় পাঠান। এছাড়া সিলেট, চাঁদপুরেও যায় তার পাঠানো পেয়ারা। ভরা মৌসুমে দৈনিক ৪শ মণ পাঠাতেন। এখন পাঠাচ্ছেন মাত্র ২০ মণের মতো। তবে এতে ভালো দাম পাচ্ছেন চাষীরা জানিয়ে তিনি বাংলানিউজকে আরো বলেন, প্রথমদিকে বেশি ধরতো পেয়ারা। তাই, দামও ছিল কম। এখন শেষ পর্যায়ে এসে দাম ভালোই- মণ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। ঢাকাসহ অন্যান্য বাজারে বিক্রি করেও দাম আসছে বেশ। এ বছরের প্রথম দিকে ৪০-৫০ টাকা মণেও পেয়ারা ছেড়েছেন চাষীরা। এতে লোকসান তো শুধু তাদেরই হয়নি, আমাদেরও হয়েছে।
তিনি বলেন, এখনও ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে পারিনি চাষীদের। লাভ না এলে টাকা দেবো কী করে! এতে ক্ষতি আমাদের, সেই সঙ্গে চাষীদেরও।
সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লিটন আরো জানান, এবার শ্রাবণের ৫/৬ থেকে ২৫/২৬ তারিখ পর্যন্ত ভীমরুলীতে প্রতিদন ১০ হাজার মণের বেশি পেয়ারা বিক্রি হয়েছে। তখন মণ ছিল ৪০/৫০ টাকা। প্রতিদিন ৫শ-৬শ চাষী পেয়ারা নিয়ে আসতেন। বর্তমানে শেষ মৌসুমে এসে এটি দেড় থেকে ২শ জনে ঠেকেছে। আর রোজ পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে হাজার মণের মতো।
ভীমরুলীতে ভাসমান এ পেয়ারা হাট দেখতে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক রিক স্ট্রিল (৬২)। ঢাকাতেই থাকেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে আসা বন্ধু নিয়ে বেড়াতে এসেছেন এখানে। সঙ্গে তার স্ত্রীও রয়েছেন। সবাই মিলে ঘুরে ঘুরে দেখলেন পুরো ভাসমান বাজার। তার মন্তব্য- থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের বিভিন্ন বড় বড় শহরে এমন জলেভাসা বাজারের দেখা মেলে। কিন্তু বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জলেভাসা বাজার-হাট গড়ে ওঠা সত্যিই অবাক করার মতো। তাও আবার জমজমাট হাট। অর্ধবাংলায় তিনি বলেন, ‘এটি দেখতে সত্যিই চমৎকার!’
অদ্ভুত সুন্দর ভাসমান এ হাট ও তার আশপাশের প্রকৃতি যে কতটা নজরকাড়া হতে পারে, এটি এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই! প্রতিবছর শত বিদেশি পর্যটক এ স্থানে ভিড় জমান পুরো পেয়ারা মৌসুম জুড়েই। বাংলাদেশিদের জন্যও যা হতে পারে অপূর্ব ভ্রমণকেন্দ্র।
বাংলাদেশ সময়: ০২১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৫
আইএ/এবি