পিরোজপুর-ঝালকাঠি-বরিশাল ঘুরে: জলের মধ্যে পেয়ারা হাট। নৌকায় করে ভেসে ভেসে বেচাবিক্রি।
একটি-দু’টি নয়, এমন হাট এখানে আরও অনেক আছে। এবার পেয়ারার মৌসুম শেষের দিকে হলেও আছে বটে এখনও। তবে মৌসুম পেরুলে আর বেশি নয়, এক কি দুই মাস এসব হাট জমবে।
পানির মধ্যে ডিঙি-নৌকা-স্টিমারে ভেসে ভেসে এমন হাট-বাজারের চিত্র বিরল। তাও আবার একটি নির্দিষ্ট পণ্যকে ঘিরে। এ যেনো পেয়ারার রাজ্য, পেয়ারাই রাজদরবার।
পিরোজপুর,ঝালকাঠি ও বরিশালের বেশ কিছু গ্রাম পেয়ারার জন্য বিখ্যাত। এই তিন জেলার তিনটি উপজেলায় দেশি পেয়ারার অধিক উৎপাদনে জুড়ি নেই। এখানকার ৩১ হাজার একরেরও বেশি জমিতে চাষ হচ্ছে সুস্বাদু এই ফল।
সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে গেছে খাল। খালের নাম স্থানের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার খেয়াঘাট পেরিয়ে মাহমুদকাঠি, কুড়িয়ানা, আটঘর, ধলহার, ব্রাহ্মণকাঠি, আদমকাঠি এরপর হঠাৎ সরু খাল বেয়ে পাশের জেলা ঝালকাঠি। তার ২/১ কিলোমিটার পরেই ভীমরুলীতে প্রবেশ। নাম উঠে এলো যেসব এলাকার, এগুলো সবই পেয়ারার আড়ত। এসব আড়তে চাষীরা কিংবা গাছিরা (স্থানীয় ভাষায় গাছারু) নৌকায় করে পেয়ারা নিয়ে আসেন,আর ট্রলারে করে আসা আড়তদার-বেপারীরা কিনে নেন।
স্বরূপকাঠি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার জলপথে এগুলেই কুড়িয়ানা। যাওয়া যায় খালের ধার দিয়ে অটোরিকশাতেও। সেখান থেকেই শুরু। এই একটি খালই সব। খালের জলের মধ্যেই একের পর এক ভাসমান হাট।
স্বরূপকাঠি খেয়াঘাট থেকে যেতে যেতে প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ চোখে আটকায়। একটু যেতেই কুড়িয়ানার আড়ত। এখানে সকাল সকাল এসে হাজির অশোক সিকদার (৪০)। ভোরে নিজেই পেড়েছেন পেয়ারা। কুড়িয়ানার ৪/৫টি আড়তের অন্যতম ভদ্রাঙ্কতে দেখা তার সঙ্গে।
বলে উঠলেন, চারিদিকের কী সৌন্দর্য, তবুও চোখে কিছু দেখি না। গত দু’মাস বাগানের মণকে মণ পেয়ারা পানির দরে যে বেচেছি সেটাই মনে পড়ছে বারবার! গত বছরও এমন ছিল না। এবারই বেশি দাম পড়েছে।
তিনি জানালেন, এ বছর চার বিঘা নিজস্ব জমিতে পেয়ারার চাষ করেছেন। বর্তমানে ৪শ’-৫শ’টাকা করে প্রতি মণে দর পেলেও আগে বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ৪০-৫০ টাকায়। তবুও বাপ-দাদার পেশা ছাড়েন কী করে।
একই কষ্ট বাবুল মণ্ডলের (৫৪)। তিনিও কুড়িয়ানার। নৌকা নিয়ে আজও এসেছেন, বৈঠা বেয়ে ভেসে ভেসে বিক্রি করছেন। সময় মতো পেয়ারা ঢাকায় কিংবা বড় শহরে পৌঁছাতে না পারায় দাম পান না বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
খানিক এগিয়ে যেতে হলো সামনে। খালে সামান্য বাঁক। কিছু দূর ভেসে এগুতেই পেয়ারা বাগান আর বাগান। পেয়ারার রাজ্য যে আসলেই কতো বড় তা এখানে না এলে বোঝাই ভার।
সোজা যেতে যেতে আদমকাঠির চাষী কার্তিক বড়ালের (৪০) বাগানে ঢুকে শুরু হলো আড্ডা। বাঁশে আংটা পেঁচিয়ে পেয়ারা পাড়তে পাড়তে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এহন সকাল ৭টা, আরও দেইর ঘণ্টা পাইড়া যামু ভীমরুলীতে বেচতে...।
বাগানের মধ্যেও রয়েছে চ্যানেল আকারের খাল। যাতে নাও নিয়ে পেয়ারা পাড়ছিলেন তিনি। পেয়ারা গাছের গোড়ার মাটি উঁচু। তার পাশে চ্যানেল। যার এক পাশ দিয়ে বের হওয়া যায় মূল খালে। ৪ একর জমির অনেকাংশে এখন ফল নেই শেষ সময় বলে। কিন্তু দাম ভালো আগের তুলনায়। কুড়িয়ানা গিয়েও তিনি পেয়ারা বিক্রি করে থাকেন।
আরও যেতে যেতে ঝালকাঠি জেলায় প্রবেশ। যে ভীমরুলীর এতো নাম-ডাক তা একটু সামনেই। তার আগেই পরিমল সমাদ্দারের (৪৫) কর্মকাণ্ডে দৃষ্টি এড়ানো গেলো কই! তিনিও পাড়ছিলেন গাছ থেকে টাটকা পেয়ারা। বড় বড় সাইজের পেয়ারা দেখে জিভে জল এলে দোষ কি।
এরপর সোজা টানে ভীমরুলী। ঢুকতেই ডানে চোখে পড়ে ভীমরুলী ডি. এন. মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সরকারি প্রাথমিক স্কুল। অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত। স্কুল মাঠের পাশেই খাল। সেখানে ট্রলার থামিয়ে একটু চোখ থিতু করলেই শত শত নৌকা পড়বে চোখে। কত ব্যস্ততা... সবই ভাসমান বাজারকে ঘিরে। বেপারী,আড়তদার ও চাষীদের পেয়ারা নিয়ে মিলন মেলা। পাইকারি দরে দেশের পেয়ারা বিক্রির অন্যতম বৃহৎ বাজার।
ভীমরুলীতে বড় ট্রলার নিয়ে বেপারী বাবুল হালদার মণ মণ পেয়ারা বোঝাই করছেন। পাঠাবেন ঢাকায়। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দম ফেলার ফুরসত নেই। ৭ থেকে ৮ নৌকা পেয়ারা কিনেছি।
একদিকে কর্মযজ্ঞ, ব্যস্ততা, ভাসমান হাটের গমগম পরিবেশ, প্রকৃতির লীলাভূমি এসবের সৌন্দর্যে অভিভূত হওয়ার আমন্ত্রণ যাত্রার শুরুতে পেলেও, এবার সত্যিই অভিভূত না হয়ে পারা গেলো না। বিস্ময়, শুধুই বিস্ময়, প্রকৃতি এত্তো সুন্দর হয় কি করে! থেকেই যেতে মন চায়...!
যেভাবে যাবেন :
মূলত তিনভাবে যাওয়া যায় ভাসমান হাটে। তিন জেলায় বিস্তৃত বলে ঘুরে দেখার উপাদান কেবল হাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পেয়ারা বাগান, সরু খাল, সে খাল বেয়ে আশ্চর্য পথ, অন্যান্য ফল-ফসল, যেমন- আমড়া, সুপারি, কচু, আখের বাগানও বিমোহিত করবে ভ্রমণপিপাসুদের।
ঢাকার টেকনিক্যাল, গাবতলী থেকে সাকুরা পরিবহনের বাস ছেড়ে যায় সরাসরি স্বরূপকাঠির নেসারাবাদে। ছাড়ে সকাল ৯টায় আর রাত ৮টায়। ভাড়া ৫০০ টাকা। এছাড়া রয়েছে হানিফ পরিবহন ও সোনার তরী বাস সার্ভিস।
স্বরূপকাঠির উদ্দেশে ঢাকার সদরঘাট থেকেও লঞ্চে ছাড়ে। বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনটি লঞ্চ রয়েছে। টিপু-৬, মরনিং সান, মহারাজ, অগ্রদূত, রাজদূত নামের লঞ্চগুলো একেক সময় একেকটা যায়)। ভাড়া ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। একক কেবিন ১ হাজার, যৌথ কেবিন ১৮শ’ টাকা।
স্বরূপকাঠি খেয়াঘাট থেকে ভাসমান বাজার দেখতে যেতে হবে ট্রলার ভাড়া করে। নয়তো তার পাশে মসজিদ ঘাট থেকে অটোরিকশা মিলবে কুড়িয়ানা-আটঘরের উদ্দেশে। তবে ট্রলারেই ভালো। একেবারে ভীমরুলী যাওয়া যাবে, ভাড়া সারাদিন ১ হাজার টাকা।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো ঢাকা টু ঝালকাঠি। ঢাকার টেকনিক্যাল,গাবতলী থেকে হানিফ বাস ছেড়ে যায় সকাল সাড়ে ৮টা, সাড়ে ১০টা, দুপুর আড়াইটা এবং রাত সাড়ে ৮টা ও সাড়ে ১০টায়। আরো আছে ঈগল, সাকুরা ইত্যাদি।
এছাড়া লঞ্চেও ঢাকা থেকে ঝালকাঠি আসা যাবে। সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ে সন্ধ্যা ৬টায়। নামতে হবে ঝালকাঠিতে সুগন্ধা নদী ঘাটে।
ঝালকাঠি বাস টার্মিনাল কিংবা সুগন্ধা নদী ঘাট থেকে অটোরিকশাযোগে সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলী হাটে আসা যাবে। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৪৫ টাকা। রিজার্ভ নিলে ২০০। এছাড়া বরিশাল হয়েও এখানে আসা যাবে।
থাকার ব্যবস্থা :
বরিশাল হয়ে এলে শহরে উন্নত মানের অনেক হোটেল রয়েছে। তবে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে (নেসারাবাদ) থানার পাশে হোটেল রিল্যাক্স, সন্ধ্যা নদীর ছোট ব্রিজ পার হলে হোটেল তাজেও থাকা যায়। ভাড়া প্রতিরাত ২০০-২৫০ টাকা।
এছাড়া ঝালকাঠি শহরে থাকার ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত। শহরের সত্যস্বরণ রোডের হালিমা বোডিং, ধানসিঁড়ি, আরাফাত, গুলজার বড় আবাসিক হোটেল। ভাড়া ২৫০-৪০০।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৫
আইএ/জেডএম
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’