নবতিপরেরা হয় বিছানায় পড়ে থাকেন, না হয় যদি শক্তি-সামর্থ থাকলেও হেঁটে-বসে কেটে যায় জীবন। কিন্তু রাজ কুমার বৈশ্যর গল্পটি আলাদা।
সেই স্বপ্নের কথাই তিনি বলছিলেন, ‘অর্থনীতিতে পড়া আমার স্বপ্ন ছিলো, কারণ বুঝতে চেয়েছিলাম দেশের মানুষ ও সমাজ ব্যবস্থা যেসব সমস্যায় পড়ে আছে, সেগুলো কেনো। অনেক পিএইচডিধারীকে দেখি তাদের জ্ঞানের পরিসীমা অগাধ, তাই আমার এই স্বপ্নের মূল উদ্দেশ্য কোনও ডিগ্রি অর্জন নয়, স্রেফ জ্ঞানার্জন।
১৯৮০ সালে রাজ কুমার বৈশ্য তার চাকরি জীবন থেকে অবসরে যান। কাজ করতেন ঝাড়খন্দের কোদারমা নামের একটি বেসরকারি ফার্মে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে। এরপরেও কেটে গেছে ৩৫টি বছর। এখন কেনো ভর্তি হলেন? সে প্রশ্নের জবাব দিলেন এক বাক্যে, ‘চীন কেনো হঠাৎই তার মুদ্রার মূল্য কমালো? সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চাই। ’ বৈশ্য আরও জানতে চান কী করে দেশের মানুষকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থেকে রেহাই দেওয়া যায়? আর কেনই বা ভারতবর্ষ তার দারিদ্রদশা ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
বৈশ্যর অন্য আগ্রহের দিকগুলো হচ্ছে বাজেট ও সংশ্লিষ্ট আর্থিক বিশ্লেষণ। “আমি বুঝতেই পারি না, সরকার অর্থ কোথা থেকে পাবে?” বিহারের জন্য মোদী সরকারের সোয়া লাখ কোটি রুপির বরাদ্দ ঘোষণার পর সেই চিন্তাই ঘোরপাক খাচ্ছে বৈশ্যর মাথায়।
‘এ অবস্থায় আমি যদি অর্থনৈতিক বিষয়ে দেশের জন্য একটিও নতুন ধারণা সামনে নিয়ে আসতে পারি, তবেই নিজের জীবনটা কোনও একটা কাজে লাগলো বলে বোধ করবো,’ এমনটাই বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে যারপরনাই খুশি রাজ কুমার বৈশ্য।
পাটনার রাজেন্দ্র নগর কলোনিতে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া ছেলে ও ছেলে বউয়ের সঙ্গে বাস করেন বৈশ্য। আট বছর আগে স্ত্রীকে হারিয়ে তখন থেকেই এই নতুন বাস। এর আগে সস্ত্রীক থাকতেন উত্তরপ্রদেশের বেরেইলিতে।
ছেলের বাড়িতে পড়ালেখা করার পরিবেশটি দারুণ। আমার ছেলে আর বউমা আমাকে গণিত আর পরিসংখ্যান শেখাবে, বলছিলেন একজন উচ্ছ্বসিত রাজ কুমার। ছেলে সন্তোষ কুমার পাটনাস্থ জাতীয় প্রযুক্তি ইনস্টিটউটে কাজ করতেন তার ছেলে বউ ভারতী এস কুমার পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশতো করতে হবে! সে প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, জানি ছাত্র মানেই পরীক্ষায় পাশ। আর আমি মনে করি না, পাশ করতে সমস্যা হবে। সকালে দুই ঘণ্টা, সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা রুটিন মাফিক পড়লে পাশ আসবেই। ’
তবে মাস্টার্স শেষ করে পিএচডি করার চিন্তা এখনই নেই বলে জানালেন তিনি। নালন্দা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এস পি সিনহার কথায়, শুরুতে সবার কাছেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য ঠেকছিলো, কিন্তু যখন তার অতীতের শিক্ষাজীবন ও বর্তমানের এই আগ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম, আমরা তাকে ভর্তি করিয়ে নিলাম।
মি. বৈশ্যর এই আগ্রহ আর উদ্যমকে বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখছে, এমনটাই বললেন এস পি সিনহা।
রাজ কুমার বৈশ্যর জন্ম ১৯২০ সালের ১ এপ্রিল বেরেইলিতে। ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন করার পর আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেন ১৯৩৮ সালে। আর ১৯৪০ সালে আইন শাস্ত্রে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপরে সংসার আর কাজের ক্ষেত্রে চাপ বেড়ে যাওয়ায় মাস্টার্স পড়া আর হয়ে ওঠেনি।
মুশায়রা শুনতে খুব পছন্দ রাজ কুমার বৈশ্যর। কখনো কখনো গোটা রাত জেগে মুশায়রা শুনতেন, এখন আর শোনেন না।
তবে এই বৃদ্ধ বয়সেও একটি শখ এখনও নিয়মিত পূরণ করে চলেন, তা হচ্ছে বই পড়া। আর টেলিভিশনে ঐতিহাসিক সিরিয়ালগুলো বেশ পছন্দের।
যোধা আকবর, রাজিয়া সুলতানা, মহারানা প্রতাপ, পছন্দের তালিকায় এইসব সিরিয়ালের কথা জানালেন বলেন বৈশ্য।
এই ছিয়ানব্বইয়েও চশমা ছাড়া পড়তে পারেন, হিন্দি আর ইংরেজিতে টানা লিখে যেতে পারেন। একটাই সমস্যা, বছর কয়েক আগে পড়ে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়ার পর এখন ওয়াকারে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়।
দীর্ঘায়ুর রহস্য কী? সে প্রশ্নে বলেন, সাধারণের জীবন যাপন আর সবকিছুই সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দেওয়াই মূলমন্ত্র।
পুরোদস্তুর শাঁকাহারি মানুষ রাজ কুমার বৈশ্য। রুটি-ডাল-চাওল-দহি আর দুধ এই তার খাদ্য।
যুবক বয়সে ভারতকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করতে যুদ্ধ করেছিলেন। দেশের অব্যাহত দুর্নীতি তাকে কষ্ট দেয়।
তারুণ্যের প্রতি রাজ কুমার বৈশ্যের আহ্বান, তারা যেনো সততার সঙ্গে কঠোরভাবে কাজ করে যায়। জীবনে সাফল্য লাভের এটাই পথ।
‘এ এক কঠিন মূলমন্ত্র তবে অসম্ভব কিছু নয়,’ বললেন বৈশ্য।
বাংলাদেশ সময় ১১২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫
এমএমকে