ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

সুস্বাদু মণ্ডা কাহিনী-১

দেশসেরা ছানা-চিনিতে মুক্তাগাছার মণ্ডা

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫
দেশসেরা ছানা-চিনিতে মুক্তাগাছার মণ্ডা ছবি: বাংলানিউজেটোয়েন্টিফোর.কম

মুক্তাগাছা ঘুরে এসে: কড়া আগুনে গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে প্রথমে তৈরি করা হয় ছানা। একটি কাঠের পাত্রে রেখে গরম এ ছানা ঠাণ্ডা করা হয়।

পানি ঝরে যাবার পর ছানার সঙ্গে পরিমাণমত চিনির সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এরপর প্রক্রিয়াজাত করে হাতে চ্যাপ্টা করে তৈরি করা হয় বিশেষ এক মিষ্টি। নাম মণ্ডা।

সরেজমিনে গিয়ে মণ্ডা তৈরির কলাকৌশলের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলানিউজকে এমন তথ্য জানান বর্তমানে মণ্ডা তৈরির অন্যতম কারিগর শ্রী রবীন্দ্র নাথ পাল ও রথীন্দ্র নাথ পাল। এ দুজন সুস্বাদু মণ্ডার স্বাপ্নিক ও প্রথম কারিগর গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর। প্রক্রিয়াজাত করার পর দানাদার ও সামান্য আঠালো এ মণ্ডা মোড়ানো হয় ওয়েল পেপারে, বলেন রবীন্দ্র নাথ পাল।  

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় তৈরি হওয়ায় এ মিষ্টির নামের পাশে জড়িয়ে রয়েছে রাজা-জমিদারদের স্মৃতিবাহী মুক্তাগাছার নাম। ময়মনসিংহের মিষ্টির ঐতিহ্য এ মণ্ডা। যুগের পর যুগ ধরে এ মণ্ডা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সমাদৃত।

স্থানীয় বাসিন্দারা যখন কোথাও যান তখন উপহার হিসেবে এ মণ্ডা নিয়ে যান। আর বাইরের লোক ময়মনসিংহে এলে লোভনীয় মুক্তাগাছার মণ্ডার স্বাদ নিতে ভোলেন না। মুক্তাগাছায় জমিদারী পরগণায় রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।

অনেক কিছুই কালপরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে গেলেও দিনকে দিন ঐতিহ্য হিসেবে টিকে রয়েছে দেশ সেরা মিষ্টান্ন মণ্ডা। উপমহাদেশেও রয়েছে এর নাম ও পরিচিতি।

ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরের উপজেলা মুক্তাগাছা। এ উপজেলা সদরের মাঝখানে রাজবাড়ির অদূরে এ মণ্ডা তৈরির কারখানা। নাম আদি ও অকৃত্রিম গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকান। এখন থেকে প্রায় ২শ’ বছর আগে ১৮২৪ সালে গোপাল পাল এক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে এ মণ্ডা তৈরির নির্দেশনা ও ফর্মুলা পেয়েছিলেন।

পরবর্তীতে বংশ পরম্পরায় তার উত্তরসূরীরা মণ্ডা তৈরিকে পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে নেন। মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী ওই সময়ে গোপাল পালের বানানো এ মণ্ডা খেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।

মুক্তাগাছার মণ্ডা এক প্রকার সন্দেশ। চ্যাপ্টা আকৃতির এ মণ্ডা তৈরির ফর্মুলা এখন পর্যন্ত ওই পরিবারটির বাইরে যায়নি। এ মিষ্টান্ন তৈরির কৌশলও বেশ গোপনীয়। বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র ও চমকপ্রদ। একেবারেই নরম এ মণ্ডা মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়।

মুক্তাগাছার শেষ জমিদার শ্রী জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী তার ‘আমি’ বইটির প্রথম খণ্ডের ২৩ ও ২৪ নম্বর পাতায় লিখেছেন, মুক্তাগাছার মণ্ডা প্রসিদ্ধ। মণ্ডা এক প্রকারের সন্দেশ। কেবল ছানা ও চিনি দ্বারা প্রস্তুত হয়। তবে ইহার ‘পাকের’ ভিতর এমনই একটি বৈশিষ্ট্য আছে যাহা অন্য কোথাও হয় না। মণ্ডার দোকানের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল।

গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর প্রয়াত শ্রী রমেন্দ্র নাথ পাল মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডা নিয়ে তাদের প্রকাশিত এক আলেখ্যে মণ্ডার বর্ণনা করেন এভাবে, মণ্ডা মিঠাই, মিষ্টান্ন, মিষ্টি যে নামেই বলি তা শুধু খাদ্যদ্রব্য হিসেবেই নয়, বরং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হিসেবেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

এ মিষ্টির মূল কারিগর গোপাল পালের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বংশধর পুত্র রাধানাথ পাল, তৃতীয় বংশধর কেদারনাথ পাল, চতুর্থ বংশধর দ্বারিনাথ পাল মণ্ডা তৈরি করেন। বর্তমানে পঞ্চম প্রজন্ম চলছে। পঞ্চম বংশধর রমেন্দ্রনাথ পালও মণ্ডা তৈরিতে কৌশল সীমাবদ্ধ রাখেন। তার মৃত্যুর পর ভাই রবীন্দ্র নাথ পাল পারিবারিক এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

বর্তমানে মণ্ডা তৈরির অন্যতম কারিগর শ্রী রবীন্দ্র নাথ পাল ছাড়াও শ্রী রথীন্দ্র নাথ পাল, শিশির কুমার পাল ও মিহির কুমার পাল-এ ৪ ভাই এখন এ মণ্ডা তৈরি করেন। আর তাদের কর্মযজ্ঞে সহায়তার জন্য রয়েছেন ৪ থেকে ৫ জন সহযোগী। তাদের বেতন ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, জানান পঞ্চম বংশধর রবীন্দ্র নাথ পাল।  

প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ কেজি মণ্ডা বানানো হয় বলে জানান প্রাণের মণ্ডা মিঠাই শিল্পী রবীন্দ্র নাথ পাল। প্রতি পিস ২০ টাকা আর প্রতিকেজি মণ্ডা বিক্রি হয় ৪০০ টাকা করে। এক কেজিতে ২০ পিস পর্যন্ত মণ্ডা উঠে। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, প্রতিদিন গড়ে ২শ’ থেকে আড়াইশ’ কেজি মণ্ডা তৈরি হয় এ কারখানায়।  

এ বাড়ির যে ঘরে মণ্ডা তৈরি করা হয় সেই ঘরে কারো প্রবেশাধিকার নেই। এমনকি বাড়ির কোন নারীও সেই ঘরে প্রবেশ করতে পারেন না। এ গোপনীয়তা প্রসঙ্গে মালিক পক্ষ থেকে জানানো হয়, পূর্ব পুরুষের নির্দেশেই তারা এ নিয়ম পালন করে আসছেন। এমনকি গোপাল পালের সেই উনুন বাদ দিয়ে জমিদার আমলে একবার মণ্ডা তৈরি করা হলেও সেই স্বাদ পাওয়া যায়নি।  

প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ কেজি মণ্ডা তৈরিতে কী পরিমাণ গাভীর দুধ প্রয়োজন হয়, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যান রবীন্দ্র নাথ পাল ও রথীন্দ্র নাথ পাল। তারা জানান, ময়মনসিংহ সদরের চরাঞ্চল, অষ্টধর, বিদ্যাগঞ্জ ও মুক্তাগাছার বিভিন্ন গ্রাম থেকে গাভীর দুধ সংগ্রহ করা হয়। এজন্য তাদের রয়েছেন জনা দশেক লোক।

মুক্তাগাছার মণ্ডার ব্যাপক চাহিদা থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে এক শ্রেণীর অসাধু মিষ্টি ব্যবসায়ী গোপালের ভাণ্ডার, গোপালের মণ্ডাসহ নানা নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ভোজন রসিকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এতে মণ্ডার ঐতিহ্য ম্লান হচ্ছে বলেও দাবি করেন মণ্ডা মিঠাই শিল্পী রথীন্দ্র নাথ পাল।

গোপাল পালের আদি ও অকৃত্রিম প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানের দালানে খোদাই করে লেখা রয়েছে, ট্রেডমার্কটি দেখে মণ্ডা কিনুন। মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ ও ঢাকাসহ দেশের কোথাও আমাদের কোন শাখা, এজেন্ট ও শো রুম নাই।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।