মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: প্রায় ২শ’ বছর আগে তৈরির সময়েই স্বাপ্নিক কারিগর গোপাল পাল এ মিষ্টির নাম দিয়েছিলেন মণ্ডা। এর উৎপত্তি প্রসঙ্গে প্রচলিত গল্পটি অনেকটাই রূপকথার মতো।
তারপর তিনি তাকে মণ্ডা তৈরির কলাকৌশল শিখিয়ে দেন। পরে তিনি এ মিষ্টি তৈরি করেন। এরপর ওই স্বপ্নপুরুষ শরীরী রূপ ধরে তার সামনে হাজির হন। সম্ভবত তখন ওই সন্ন্যাসীই এর নাম দেন মণ্ডা।
ওই সন্ন্যাসী গোপাল পালের মাথায় হাত রেখে এও বলেছিলেন, তোর হাতের তৈরি এ মণ্ডা খেয়ে সবাই অশেষ সুখ্যাতি করবে। তোর মণ্ডা একদিন জগৎ বিখ্যাত হবে।
পুরুষানুক্রমে তুইও এ মণ্ডা মিঠাই শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করবি। তোর অবর্তমানে তোর পরবর্তী পুরুষদের হাতেই শুধু সুস্বাদু এ মণ্ডা তৈরি করা সম্ভব হবে।
জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে এ মণ্ডা খাওয়ানোর পর তৃপ্ত হলে গোপাল পাল নিয়মিতই এ মিষ্টান্ন বানানো শুরু করেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সবাই এ মিষ্টান্নতে আকৃষ্ট হন।
মুক্তাগাছার আদি ও অকৃত্রিম মণ্ডার দোকানে প্রবেশ করতেই কাঁচের সুদৃশ্য শোকেসে সুরক্ষিত অবস্থায় গোপাল পালের একটি কাঠের প্রতিকৃতি চোখে পড়ে। ১৯০২ সালে রাজবাড়ির কাঠমিস্ত্রী স্বরূপ সূত্রধর নান্দনিক এ প্রতিকৃতি নির্মাণ করেন।
বাংলানিউজকে মণ্ডা তৈরির গল্প বলতে গিয়ে ১৮২৪ সালের ঘটনা তুলে ধরেন গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর শ্রী রথীন্দ্র নাথ পাল।
তিনি বলেন, আমার দাদার দাদা গোপাল পাল মিষ্টি বানানো সম্পর্কে স্বপ্নে আদিষ্ট হন। এক সন্ন্যাসী নিজ হাতে তাকে চুলা তৈরি করে দিয়ে যান।
বলেন, এ চুলাতে মিষ্টি বানালে জগৎ বিখ্যাত হবে। সেই থেকে শুরু। এখন পর্যন্ত আমরা পঞ্চম পুরুষ এ ব্যবসায় জড়িত।
ওপার বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, সেই ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে গিয়ে মণ্ডা খেয়েছিলাম। অন্য রকমের মিষ্টি। খেতে খুব ভাল। সেই স্বাদ আজও আবছা মনে আছে। তারপরে আর মণ্ডা খাইনি। তবে, মণ্ডা অন্য কোনো নামে বা আকৃতিতে হয়তো বাংলায় বেঁচে রয়েছে।
মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ির হাতি ছিল। যার নাম শম্ভু। সেই শম্ভুর নামেই ময়মনসিংহ শহরের অদূরে ব্রক্ষপুত্রের ওপারে শম্ভুগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছে। এ হাতিরও ভীষণ পছন্দ ছিল মণ্ডা, এমন লোকশ্রুতিও রয়েছে স্থানীয়দের মাঝে।
এ দোকানের সামনেই ৩০ বছর ধরে মনিহারী দোকান করেন হরেন্দ্র বিশ্বাস (৫০)। তার ভাষ্যে, জমিদারগোর হাতিরাও মণ্ডা খাইতো বলে বাপ-দাদার কাছ থেইক্যা শুনছি। ‘
জমিদার জামানায় মণ্ডার কেচ্ছা সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্থানীয় আটানি বাজার এলাকার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব হাবিবুর রহমান হাবু বলেন, জমিদারগর সময় মণ্ডা আছিল সস্তা। তাগর মেলা হাতি আছিল। তাগোর হাতিরাও মণ্ডা খাইতো।
মুক্তাগাছার শেষ জমিদার শ্রী জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরী গোপাল পালের তৃতীয় বংশধর কেদার নাথ পালকে ১৯৫৩ সালে নিজের প্যাডে লেখা এ মণ্ডার একটি প্রশংসাপত্র এখনো বাঁধানো রয়েছে মণ্ডার দোকানের দালান ঘরের দেয়ালে কাঁচের ফ্রেমে।
সেখানে লেখা হয়, আমাদের পূর্ব পুরুষগণের আমল হইতে মণ্ডা ও রসগোল্লা সরবরাহ করিয়া আসিতেছে এবং এই মণ্ডা ও রসগোল্লা আমাদের স্থাপিত বিগ্রহাদির ভোগেও দেওয়া হইতেছে। কাজেই ইহাদের বিশুদ্ধতা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। আমরাও ইহা ব্যবহার করিয়া সন্তুষ্টই আছি।
আবার কারো কারো মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে দুগ্ধজাত মিষ্টির ঐতিহ্য অনেক আগেরই। মুঘল আমলে বিশেষ ধরনের মিষ্টির প্রসার সম্পর্কে জানা যায়। এ হিসেবে ধারণা করা যায়, মণ্ডার উৎপত্তি এরও আগের।
স্বর্গলাভ করা গোপাল পালের উত্তরসূরী ও স্থানীয়রা জানায়, এ মণ্ডা ছাড়া জমিদারদের প্রাত:রাশ হতো না। শুধু তাই নয়, সেখানকার আমলা-কর্মচারীদেরও মধ্যাহ্নকালীন জলখাবার হতো এ মণ্ডা দিয়ে। ষোল হিস্যার জমিদার বাড়ির দেব-দেবীর পূজা অর্চনায় ভোগের অন্যতম উপকরণ ছিল মণ্ডা।
জমিদাররা যখন মুক্তাগাছার বাইরে বিভিন্ন রাজা-বাদশার বাড়ি ও ব্রিটিশ শাসকদের সাথে সাক্ষাত করতে যেতেন তখন সঙ্গে থাকতো প্রাণের মণ্ডা মিঠাই। তাদের এখানে নামকরা কোন অতিথি এলে মণ্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করাটাই ছিল ট্র্যাডিশন।
এ মণ্ডা খেয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেতার বাদক ও সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিখ্যাত চিকিৎসক ও পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধান চন্দ্র রায়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। সূর্যকান্ত মহারাজার পুত্র মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রিয় ছিল এ মণ্ডা। তিনি একবার রাশিয়ার নেতা স্ট্যালিনকেও গোপাল পালের এ মণ্ডা পাঠিয়েছিলেন।
পাকিস্তান আমলে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কয়েকবার এ দোকানে মণ্ডা খেতে এসেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি একবার চীন সফরকালে এ মণ্ডা নিয়ে গিয়েছিলেন আরেক বিপ্লবী নেতা মাও সেতুংয়ের জন্য। মাও সেতুংও এ মণ্ডার দারুণ প্রশংসা করেছিলেন।
ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরো অনেকে এ মণ্ডার প্রশংসা করে গেছেন। মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও গোপাল পালের মণ্ডার দোকানে এসেছিলেন। মণ্ডা খেয়ে তিনিও এর প্রশংসা করে গেছেন এমনও তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে মণ্ডার প্রকাশিত আলেখ্যে।
২০০৯ সালের ১৭ জুন জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ খান স্বভাবসুলভ রসিকতা করে সেই সময়কার স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী খালিদ বাবুকে মণ্ডা খাওয়ানোর কথা বলেন। পরদিন জীবনে প্রথমবার এমপি হওয়া কাজী বাবু ৭০০ পিস সুস্বাদু মণ্ডা নিয়ে সংসদে হাজির হন। এরপর সংসদে মণ্ডা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫
জেডএম/
** দেশসেরা ছানা-চিনিতে মুক্তাগাছার মণ্ডা