স্বরূপকাঠি-ভীমরুলী (পিরোজপুর-ঝালকাঠি) থেকে ফিরে: পেয়ারা টুকরো ঘণ্টা খানেক সেদ্ধ করতে হবে। এরপর পাতলা কাপড় দিয়ে চিপে রস বের করে প্রতিকাপ রসে পরিমাণ মতো চিনি ও লেবুর রস মেশাতে হবে।
এভাবেই স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, মাহমুদকাঠি, ভীমরুলীর স্থানীয়রা পাকা পেয়ারা দিয়ে জ্যাম-জেলি তৈরি করেন। একান্তই নিজস্ব প্রচেষ্টায়। চাষি-কৃষক পর্যায়ে কিংবা সাধারণ স্থানীয়রা একেবারে পাকা পেয়ারা না ফেলে তা কাজে লাগানোর উপায় হিসেবে এমনটি করছেন বলে জানান নেসারাবাদ স্বরূপকাঠি পৌরসভার মেয়র মো. শফিকুল ইসলাম ফরিদ।
আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র, এই তিনমাস স্বরূপকাঠি থেকে ভীমরুলীর (পিরোজপুর-ঝালকাঠি) বিভিন্ন গ্রামে বাম্পার উৎপাদন হয় পেয়ারার। নানামাত্রিক সুযোগের অভাবে তা সময় মতো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে না পৌঁছানোয় এখানকার পেয়ারা এখানেই থেকে হারাচ্ছে গুণমান, হচ্ছে পাকা, যাচ্ছে পচে। তা থেকে সাময়িক মুক্তি এই জ্যাম-জেলি।
নাস্তার টেবিলে সুস্বাদু জেলির তৃণমূল দেখতে পেয়ারা মৌসুমে এসব এলাকায় ভিড় করেন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা। পুরো-দস্তুর ভ্রমণকেন্দ্র না হলেও বিদেশিদের আনাগোনা ভালোই। এমনই একজন রিক স্টিল। বয়স ৬২। তবে দেখে বোঝারই জো নেই। হেঁটে-হেঁটে বহু পথ পেরিয়ে তখন মধ্য দুপুরে কুড়িয়ানার ভাঙা-ব্রিজে। বাংলানিউজকে জানালেন, জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে তার আগ্রহের কথা।
নির্জন পথ। থেকে থেকে ২/১টি বেপারী ট্রলার ভটভট শব্দ করে এগিয়ে যায়। ক্রমেই সরু হয়ে ওঠা খাল হঠাৎই যেন পায় বিস্তৃতি। জলের ধারে পেয়ারা বাগান। খালের একেবারে কিনারায় নুয়ে পড়েছে অন্যান্য গাছ। হালকা বাতাস আর ছায়া সমাহারে প্রশান্তিও কম যায় না। এমনই পথ মাড়িয়ে পৌঁছানো জলে ভাসা হাট ভীমরুলীতে। যার তুলনা অস্ট্রেলিয়ান রিক স্টিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আমতা-আমতা ভাষায় মত দিলেন, মুগ্ধ করেছে তাকে ঝালকাঠির ভীমরুলী জলবাজারের সৌন্দর্য। পানির ওপর যেনো জলজ্যান্ত হাট। এখানকার পণ্য পেয়ারা। সারি সারি নৌকার ওপর সবুজ–হলুদ মণ-মণ স্বাদের ফল। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখেই অবাক রিক স্টিল। কাছে গিয়ে তো আরও বিস্ময়! খালের ওপর এ এক আজব বাজার...।
তার ভাষায়, ‘It’s amazement. What a floating market. It’s very beautiful. We like it. The floating market is like Thailand, Vietnam.’
তার সঙ্গে এসেছিলেন ডরোথি হিকম্যান। রিক স্টিল তো ঢাকায় থাকেন, কিন্তু ডরোথি সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন। প্রিয় বন্ধুর অমন্ত্রণে ভ্রমণে এসে কেমন লাগছে ভাসমান হাট ঘুরে দেখতে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, উচ্ছ্বাসের কথা। বললেন, বাংলাদেশ একটি সাধারণ দেশ। এর একটি গ্রাম-একটি জেলা এতো সুন্দর হতে পারে এ কথা বিদেশে কেউ কল্পনাই করে না।
তিনি আরও জানান, পুরোপুরি পর্যটনকেন্দ্র না হয়েও প্রাকৃতিক সম্পদে এই গ্রামগুলো (স্বরূপকাঠি থেকে ভীমরুলী) এতো বৈচিত্র্যমণ্ডিত যার উপমা না ঘুরে খোঁজ করা অসম্ভব।
রিক স্টিলের স্ত্রী সারাহ গার্নেও এসেছেন সঙ্গে। তিনি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিসিডিডিআরবি) একজন গবেষক। চাকরি সূত্রে স্বামীসহ ঢাকায় থাকেন। এখানে এসে দেখেছেন, পেয়ারা বাগান, ভাসমান হাট, নির্জন শোভা আরও কত কী।
তিনজনেরই মন্তব্য, এ এলাকায় এতো পেয়ারা উৎপাদন হয় যা আশা জাগানিয়া। বিরাট আশাকে জিইয়ে রাখতে দেশব্যাপী ছড়াতে হবে এখানকার পণ্য। এছাড়া পাকা পেয়ারার চাহিদা কম থাকলেও জ্যাম-জেলি তৈরি করে একে মূল্যবান করে তোলা সম্ভব। প্রয়োজন জেলির বাণিজ্যিক প্রসার।
শুধু তারাই নন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে বিদেশিদের ভিড় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে (বিশেষ করে পেয়ারা মৌসুমে, এছাড়া শীতেও)। দেশি ভ্রমণপিপাসুরাও আগ্রহী হচ্ছেন এখানে ঘুরতে আসতে।
অস্ট্রেলিয়ান এই নাগরিকদের নিয়ে এসেছেন ট্রিপ টু বাংলাদেশ নামক প্রতিষ্ঠানের ফ্রিল্যান্সার গাইড নিয়াজ মোরশেদ। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মাহমুদ হাসান খান মানিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজার হাজার পর্যটককে গ্রাম ও প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বিদেশি অতিথিদের গ্রামাঞ্চলে ঘুরতে পাঠান। ঘুরিয়ে দেখান এই বাংলার রূপ-মায়া। তিনি চান দেশের অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মতো এই এলাকা যেন জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তারই ধারাবাহিকতায় অস্ট্রেলিয়ানদের নিয়ে আসা।
পাশের জেলা ঝালকাঠির ভীমরুলীর পেয়ারা বাগানি গৌতম মিস্ত্রী। আড়াই বিঘা জমিতে তার বাগান। বাংলানিউজকে জানালেন, গেলোবার ভরা মৌসুমে পেয়ারায় বেশি ক্ষতি হয়নি। কারণ যে পাকা নিয়ে ভয়, তা ছিল না। প্রাণ কোম্পানি অনেক পাকা পেয়ারা নিয়েছিল জেলির জন্য। তবে এবার তারা আসেনি। ফলে মাথায় হাত। একই সুর আদমকাঠির চাষি পবিত্র ঢালীর। শুধু তাই নয়, এমন অভিমত অন্য চাষি-বাগানিদেরও।
৫নং কীর্তিপাশা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও আড়তদার লিটন হালদার বাংলানিউজকে বলেন, সহযোগিতার তেমন কেউ নেই। গতবার প্রাণ কোম্পানি নিয়েছিল পেয়ারা, এবার তারা নিলো না। ফলে চাষিরা বঞ্চিত হলো ন্যায্য দাম থেকে।
তিনি বলেন, গতবার প্রাণ দৈনিক ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ মণ পেয়ারা কিনেছে। এবারও যদি তাই হতো তবে অনেক উপকার পেতাম। এছাড়া শুনেছিলাম পারটেক্স গ্রুপও নাকি জুস-জেলির জন্য পেয়ারা নেবে, কই তারাও তো এলো না। এতো বিপুল উৎপাদন ফলের, যা দেশের সবপ্রান্তে পাঠাতে আমারা স্থানীয় আড়তদাররা সক্ষম নই। সরকারসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে তো ভালোই হয়। একটু নজর দিক না আমাদের দিকে। এতে গরিব চাষিরাই তো খেয়ে-পরে বাঁচবে।
সংশ্লিষ্টদের মত, এই অঞ্চলের বিপুল উৎপাদিত পেয়ারা দিয়ে জুস-জেলি তৈরি করে তা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। এতে অর্জন করা যাবে বৈদেশিক মুদ্রাও। এ জন্য চাই উদ্যোগ বা উদ্যোক্তা।
এদিকে পেয়ারা সংরক্ষণে এই এলাকায় একটি হিমাগারের দাবি করেছেন পিরোজপুরের নেসারাবাদ স্বরূপকাঠি পৌরসভার মেয়র মো. শফিকুল ইসলাম ফরিদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কারো মুখের দিকে তাকাতে চাই না। সেজন্য প্রয়োজন কেবল একটি ‘পেয়ারা হিমাগার’।
স্বরূপকাঠিতে না হোক, কুড়িআনা-আটঘর কিংবা ভীমরুলীতে এটি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান তিনি।
শুধু পেয়ারা নয়, স্বরূপকাঠি থেকে ভীমরুলী পর্যন্ত এলাকায় আমড়া, সুপারি, কলা, পেঁপে, কাকরোল, কচু, সিম, বরবটি, লেবু, তাল, আখ, নারিকেলসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ হয় প্রচুর। বিপুল সম্ভাবনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই। শুধু প্রয়োজন খানিক সহায়তা।
কীর্তিপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আগামী পেয়ারা মৌসুমের আগেই ঝালকাঠি থেকে কীর্তিপাশা হয়ে ভীমরুলী সরাসরি চলবে বাস। আমি এই লক্ষে কাজ করছি। এতে যেমন সহজ হবে পণ্য পরিবহন, সেই সঙ্গে আসবেন আরও দেশি-বিদেশি পর্যটকও। আর তাই এই এলাকাকে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা দেওয়া যায় কিনা, প্রশাসনকে ভেবে দেখার দাবি তার।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৫
আইএ/জেডএম
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’