স্বরূপকাঠি (পিরোজপুর) থেকে ফিরে: চা বানানোতে আলাদা একটা মজা আছে। আলতো হাতে তা বানিয়ে দিলে টের পাওয়া যায় চুমুক দেওয়া ব্যক্তির মুখের দিকে তাকালে।
চা বানানো একটি সৃজনশীল কাজ- চোখে মুখে এমনই ভাষা তার। কিন্তু শব্দ চয়নে তা আর পরিষ্কার করতে পারলেন কই! আমতা আমতায় বোঝালেন, চা পানের জন্য কোনো ব্যক্তি তার বেড়ার দোকানে এলে সাধ্য মতো খুশি করার প্রচেষ্টার কথা। চায়ের পেয়ালা হাতে দেওয়ার পর ব্যক্তিটি যখন চুমুক দেন তার চোখে-মুখে কোমল দৃষ্টি দিয়েই বোঝেন আসলেই খুশি করতে পেরেছেন কিনা!
পড়াশোনা কখনও করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তাতে কী আসে যায়। এটাই কী জীবনে সব! সৃজনশীলতা একটি চায়ের কাপের মধ্য দিয়েও যে প্রস্ফুটিত হতে পারে এমনই ভাবনায় সময় গড়িয়েছে তার।
একটি অজপাড়াগায়ে বসেও ভাবনার বিস্তর ঘটান বলেই তার ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত। পাশের জেলা বরিশাল গিয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়ছেন মেয়ে। ছেলের চাকরি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে।
কথা হলো তার সঙ্গে। তবে বেশি নয়, কাজের সময় কম কথা বলতেই পছন্দ। চা বানানোর পদ্ধতিটাও একটু ব্যতিক্রম এই বিক্রেতার। প্লাস্টিকের বড় বোতল ভর্তি শুকনো চাপাতা। সঙ্গে দু’কেটলি আর চিনির কৌটা। রং চা-কেই সেরা মানেন। জানালেন, আসল চা তো রং চা’কেই বলে। দুধ চা’তো শহরের সৌখিনতা মাত্র...।
সারি সারি কাঁচের কাপ। ধুয়ে রেখেছেন গরম জলে। আরও উতলে উঠলে (পানি) ঢালবেন। ছাকনিতে শুকনো চাপাতা দিলেন, এবার তার ওপর জল। চাপাতার আস্তরণ ভেদ করে ছাকনি হয়ে জল গড়িয়ে পড়লো কাপে। সেখানে আগে থেকেই ছিল হালকা চিনি। নেড়ে করলেন পরিবেশন। ব্যস হয়ে গেলো চা। ধোঁয়া ওঠা চা। সব হাতে এমন চা হবে, কিন্তু স্বাদ হবে না বা হয় না, এমনই দাবি করলেন তিনি।
কুড়িয়ানা খালের বিপরীত দিকে তার অবস্থান, মানে খালের উত্তর পাশে। জায়গাটার নাম আদাবাড়ি। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। স্বরূপকাঠির আগে একপাশে কচা অন্যপাশে সন্ধ্যা নদী। তার পুবে বয়ে গেছে খাল। এই পথেই কুড়িয়ানা হয়ে আদাবাড়ি। মূলত খালটির ক্ষুদ্র একটি শাখায় এর অবস্থান। আর প্রধান খাল তো একটিই। যা সোজা পথ ধরেছে ঝালকাঠির। পরে নলছিটি হয়ে বরিশাল জেলাতে গিয়ে মিশেছে।
ম্যানগ্রোভ বনের মতো জোয়ার-ভাটার খেলা না থাকলেও, হঠাৎ কাউকে চোখ বুজে নিয়ে এলে ভুল করার আশঙ্কাই সত্যি হবে। ধারণা কিংবা কল্পনার একটি সৌন্দর্য অঙ্কন যেখানে শেষ, স্বরূপকাঠি টু ঝালকাঠির খাল পথের (নৌপথ) জার্নি সেখানেই শুরু। ছবিতেও বেঁধে রাখা দায়। মনে হবে ওয়ালপেপার!
এ খালের দুই পাশে সারি সারি গাছ। কোনোটার মাথা উঁচু, কোনোটা নুয়ে পড়েছে। হঠাৎ সরু হবে, তখন শিহরণ জাগবে, গায়ের লোম খাড়া হবে। এমনই প্রকৃতি এটি। আবার একটু এগিয়ে গেলেই পেয়ারার রাজ্য তথা বাগান।
বন, পেয়ারা বন। বন, এ বন আমড়ার, সুপারি, নারিকেল, তাল ও আখের। এছাড়া কুড়িয়ানা থেকে খালের পাড়ে গড়ে উঠছে বেশ কয়েকটি পেয়ারা বিক্রির ভাসমান হাট। বিক্রি হয় আমড়াও। কুড়িয়ানা, আটঘরের পর সবচেয়ে বড় হাট ঝালকাঠির ভীমরুলী। আরও আছে ডুমুরিয়া, বেতলা ও ডালুহার।
ভীমরুলীকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি পেয়ারা হাট বলা হয়। ভাসমান বিষয়টি তো এর আরও একটি গুরুত্বের দিক। চাষিরা কিংবা গাছিরা (স্থানীয় ভাষায় গাছারু) নৌকায় করে পেয়ারা নিয়ে আসেন হাটে, ট্রলারে করে আসা আড়তদার-বেপারী-ব্যবসায়ীরা কিনে নেন।
এমনই আড়তদার-বেপারী-ব্যবসায়ীরা বেঞ্চে বসা। ভর দুপুর। সূর্যের তেজও বেশ। এদিকে পেয়ারা-আমড়া সংগ্রহ শেষ। বেলা ১টার কিছু পরে ছাড়বে গাড়ি; এই চিন্তা মনে। তবে মাথা ব্যথা যাই হোক চা পান করেই সব ক্লান্তি দূর।
আড়তদাররা কুড়িয়ানা তো বটেই খানিক দূরের আদমকাঠি, ভীমরুলী থেকেও পেয়ারা-আমড়া সংগ্রহ করেছেন। যাবে ঢাকা, ট্রাকে-পিকআপে করে। যার রুট প্রথমে কুড়িয়ানা দিয়ে হিমানন্দকাঠি, নবগ্রাম হয়ে বরিশাল।
কুড়িয়ানা খালের বিপরীত দিকে তার অবস্থান, মানে খালের উত্তর পাশে (আদাবাড়ি)। তার থেকে একটু এগিয়ে গেলেই বরিশালের পথ। বট ও মেহগনি গাছের মধ্যখানে মাচা আকারে ছাউনি করেছেন অস্থায়ী দোকানের।
প্রতিবছর এখানেই বসেন, তবে মাত্র কয়েক মাসের জন্য, খালি পেয়ারার মৌসুমে (আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র ও পরে আশ্বিনের কয়েক দিন)। কারণ এ সময়টায় জমজমাট থাকে হাট ও হাটপাড়। পেয়ারা-আমড়ার মতো চাও মৌসুমি তার।
কেবল তিনিই নন তার মতো এমন অনেকেরই এই সময়টায় বেশ জমে আয়-ইনকাম। চলে পেয়ারা-আমড়ার মতো মৌসুমি কর্মকাণ্ড।
ডিঙি-নৌকা বেয়ে চাষি-বাগানি থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী পর্যন্ত বিভিন্ন পদের লোকের আনাগোনায় চা বিক্রিরও ধুম হয়। দৈনিক ৫-৬শ’ টাকা আয়। খচর বাদে লাভ থাকে প্রায় অর্ধেক।
এছাড়া সম্বল দেড় বিঘা জমি। চাষ হয় পেয়ারা, আমড়া, কচু, লেবু ও টুকটাক সিমও। বাড়িতে একটি গাভী ও হাতে গোনা হাঁস-মুরগি আছে। আগে ছিল ছাগল। এখন নেই, বড় মেয়ের বিয়ের পর জামাই যেদিন প্রথম বেড়াতে আসেন সেদিন রাঁধতে হয়েছে খাসির মাংস।
পরিবারের কথা উঠতেই, পরিচয় একেকজনের দিলেন। বাড়িতে স্ত্রী, এক ছেলে ও মেয়ে। বড় মেয়ে মনিকা, যার বিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর আগে। ঝালকাঠির বিন্নাপাড়ায় মেয়ে থাকে শ্বশুরবাড়িতে। জামাই চাকরিজীবী, চট্টগ্রামে থাকেন। ছেলে রথিন বাবার সঙ্গেই আছেন। মোবাইল টাওয়ারের ইনচার্জ। সবার ছোট মেয়ে মহিমা বরিশালের একটি কলেজে সমাজকর্মে সম্মান শ্রেণিতে পড়ছেন।
সব মিলিয়ে যা আয় হয়, খরচ তার চেয়ে অনেক বেশি। হিমশিম খেয়েই জীবনের এতোগুলো পেয়ারা মৌসুম পার করেছেন। আশপাশের ৩৬ হিন্দু গ্রামের মধ্যে তাদের গ্রামটি অন্যতম। গ্রামে ধার করে চলতে হয়, ঋণ আছে গ্রামীণ ব্যাংকেরও। তবে মাসে মাসে সুদের টাকা দিতে দিতে হয়রান। যা উল্টো বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ততক্ষণে চা প্রস্তুত। নতুন করে পানি গরম দিয়েছিলেন বলে খানিক গল্পে মেতে ওঠার সময়টুকু পেলেন।
হাতে চায়ের কাপ দিতে দিতে আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ভবিষ্যত বলে কিছু নেই, জীবনের শেষ সময়। সারাটা সময়ই পার করলাম পেয়ারা-আমড়া আর কচুর সঙ্গে। এ থেকেই উন্নতির চেষ্টা। আমি তো তিন মাস চা বিক্রেতা, নয় মাস মজুর। এভাবেই জীবন চলে আমার মতো গৌরঙ্গ মণ্ডলের (৫২)।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫
আইএ/এমএ
** ‘আমড়া বন্ধনে’ সম্ভাবনা বিশ্ব ছোঁয়ার
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’