অরণ্যচারী মানুষদের কাছে অখাদ্য বা অভক্ষ্য বলে কিছু নেই। সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো, পোকা-মাকড় সবই দিব্যি আছে তাদের খাদ্য তালিকায়।
ওই কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার গ্যাব্রিয়েল মট (Gabriel Mott)। অভিনব চিন্তাটা মূলত তার মাথায়ই প্রথমে আসে। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ার সময় তিনি সমমনা কিছু বন্ধুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে ২০১৩ সালে গড়ে তোলেন এই কোম্পানি। ছাত্রদের জন্য সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের স্টার্ট আপ কমপিটিশন নামের একটি কমপিটিশন হয়ে থাকে তাদেরর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেটি হাল্ট প্রাইজ (Hult Prize) নামে পরিচিত। ওই পুরস্কারের ১০ লাখ ডলার দিয়ে মট ও তার উদ্যমী বন্ধুরা খোলেন একটা ব্যতিক্রমী কোম্পানি। সে-কোম্পানি আজ বড়সড় ফুড কোম্পানি হিসেবে দাঁড়িয়েও গেছে। তবে তারা গতানুগতিক পথে নয়, হেঁটেছেন স্রোতের বিপরীতে উল্টো পথে। নইলে কি আর পোকা-মাকড়কে খাদ্যপণ্য হিসেবে বিক্রি করার অভিনব চিন্তা মাথায় আসে!
প্রথমে তারা গেলেন থাইল্যান্ড সফরে। দেশটিতে বেশ কিছু কোম্পানি কীট পতঙ্গকে (বিশেষত ঝিঁঝিঁপোকাকে) খাদ্যপণ্য হিসেবে বিক্রি করে চুটিয়ে ব্যবসা করে আসছে (Thailand, a country already home to several edible-cricket farms)। থাইল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এরপর তারা কেনিয়া, ঘানা ও মেক্সিকোতে গিয়ে গবেষণা করে এলেন।
বলা বাহুল্য, এসব দেশের লোকেরা প্রকৃতি থেকে কীট-পতঙ্গ ধরে মুখরোচক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এরপর তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
Aspire Food Group—এখন পতঙ্গকে মুখরোচক খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় করবার কাজে বেশ সফল এক নাম।
টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অস্টিনে একটি পরিত্যক্ত স্থানে ১৩ হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে অ্যাসপায়ার ফুড গ্রুপের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রিকেট ফার্ম। সেখানে অসংখ্য কক্ষে শত শত বাক্সে ‘লালন’ করা হচ্ছে নানা ধরনের পতঙ্গ। তারা আশাবাদী যে, অন্যসব দেশের মানুষের মতো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষের খাদ্য তালিকায়ও একদিন স্থান করে নেবে কীট-পতঙ্গের মতো অপ্রচলিত খাবার।
তাদের আশাবাদকে ফেলনা বলে উড়িয়ে দেবেন না যেন! পতঙ্গ-ভোজনবিলাসীদের অনেকেরই ধারণা, পোকা-মাকড় একদিন পশ্চিমাদের খাদ্য তালিকায় স্বাভাবিক খাবারের মতো স্থান দখল করে নেবে। সেদিন আসতে খুব বেশি দেরি আর নেই। তাদের যুক্তি, দুনিয়ার ৮০ ভাগ ভাগ দেশের মানষই নাকি কীট-পতঙ্গকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। যদিও তাদের এই দাবির পক্ষে অকাট্য প্রমাণ নেই। গ্যাব্রিয়েল মট (Gabriel Mott) নিজেও এমন আহামরি দাবি করেন না। তবে তিনি জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন(ফাও)-এর একটি রক্ষণশীল পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন।
ওই পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দুনিয়ার অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ পতঙ্গভোজী।
মার্কিনিদের হুজুগপ্রিয়তা ও নতুনত্বলোভী মনোভাবকে সম্বল করে অ্যাসপায়ার কোম্পানি তাকিয়ে আছে অনাগত সোনালি এক ভবিষ্যতের দিকে। আপাতত হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগিয়ে চলছে তাদের কার্যক্রম। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ঘানা ও মেক্সিকোতে তারা পতঙ্গ খামার খুলেছেন। ক্ষেত্রটা যেহেতু একদমই নতুন তাই তাদের কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র জনাদশ। যদিও পতঙ্গ লালন পালনে তেমন কোনো জ্ঞান বা দক্ষতার প্রয়োজন নেই। তাই অস্টিনের ফার্মটির পাশে নতুন আরও একটি ফার্ম গড়ে তুলছেন তারা।
কীট পতঙ্গকে মানুষের খাদ্য হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার ব্যাপারটা যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে একেবারেই নতুন, সেজন্য তা এখনও রয়ে গেছে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে। যে পতঙ্গ তারা চাষ করবেন তা যেন স্বাস্থ্যবান, আকারে বড়, আরো বেশি সুস্বাদু ও পুষ্টিমানে ভরপুর হয়-- –এখন সেদিকেই অ্যাসপায়ার ফুড গ্রুপের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত। সেজন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা, পতঙ্গের উপযুক্ত খাদ্য, আর্দ্রতা, ওদের উপযুক্ত থাকার পরিবেশ ও পানির সরবরাহ এসবের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে তাদের। মানে তারা এখনো শিখছেন।
পতঙ্গগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাঁচে, বংশবিস্তার করে এবং মরে যায়। এরপর ওগুলোর ঠাঁই হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্রিজারে। শেষমেষ এগুলোকে বিক্রি করা হয় পাইকারী দরে বিভিন্ন নামীদামী রেস্তোরাঁর কাছে---আস্ত আকারে এবং গুঁড়ো অবস্থায়। দু’একটি কোম্পানির পতঙ্গ-গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ময়দাও পেয়ে গেছে বাহারি নাম---যেমন, Exo কোম্পানির ক্রিকেট ফ্লাউয়ার প্রোটিন বার আর Bitty Foods কোম্পানির ক্রিকেট বেকিং ফ্লাউয়ার পতঙ্গলোভীদের চাহিদার শীর্ষে।
পতঙ্গদের জীবনচক্র মূলত ছ’সপ্তাহ স্থায়ী হয়। এরপর প্যাকেটজাত করা হয় ওদের। মড়া পতঙ্গের স্থানে আনা হয় নতুন পতঙ্গ ---এভাবেই চলতে থাকে প্রক্রিয়াটা। ফার্মে পতঙ্গ চাষের পথে কিছু প্রাকৃতিক বাধাও আছে। এরা মূলত পতঙ্গভূক বন্যপ্রাণি। বিশেষ করে শেয়াল, নেকড়ে ও অতিকায় মাকড়শা। এরা যাতে ‘লাভের গুড়ে পিঁপড়া’ হিসেবে আবির্ভূত না হতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এভাবে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’—এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে গ্যাব্রিয়েল মট ও তাঁর বন্ধুদের স্বপ্নের অভিনব কোম্পানি অ্যাসপায়ার ফুড গ্রুপ।
পোকাদের খাদ্যগুণও ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলেছে তাদের। দেখা গেছে, রান্না করা প্রতি ১শ গ্রাম পোকায় আছে উন্নত মানের ২১ থেকে ২৮ গ্রাম প্রোটিন। তাছাড়া জাতিসংঘও বলছে এদের চাষ করতে জায়গা লাগে সবচেয়ে কম, পানির চাহিদাও সবচেয়ে কম, গ্রিনহাউজ গ্যাস নি:সরণও হয় সবচেয়ে কম। সবচেয়ে বড় কথা, পতঙ্গেরা হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের খাদ্য। এই পতঙ্গ-খাবার স্বাভাবিক খাবারের ওপর থেকে চাপ কমাবে।
পশ্চিমা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমের কয়েকটি শিরোনামে চোখ বোলানো যাক এবার:
Sweden Is Trying To Make Everyone Eat Bugs From Giant Vermin Farms
A Brooklyn Duo May Have Finally Figured Out How To Get Americans To Start Eating Insects
If We Really Want To Save The World, We Have To Start Eating Bugs
শেষের শিরোনামটি তো রীতিমতো ভাবনার খোরাক জোগানোর মতো। দেখা যাক, মার্কিন মুল্লুকের গ্যাব্রিয়েল মট ও তার বন্ধুদের ‘রসনায় পতঙ্গ বিলাসে’র এই অভিনব যাত্রা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে গড়ায়। হারাবার কিছু তো নেই, জয় করবার জন্য তাদের সামনে পড়ে আছে এখন সমস্ত পৃথিবী।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫
জেএম