মুক্তাগাছা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: স্বাদ এবং সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত ছিল মুক্তাগাছার মণ্ডা। ময়মনসিংহে এসে অমৃত স্বাদের এ মণ্ডা চেখে দেখেননি এমন মানুষ নেহায়েতই কম।
অবশ্য মণ্ডা মালিকরা জানান, আগে দেশি গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি হতো ছানা। এখন আর আগের মতো খাঁটি দুধ নেই। বিদেশি গরুর দুধ দিয়ে এখন তৈরি করা হয় ছানা। এসব প্রজাতির গরু ঘাস-লতা-পাতা খায় না। ফলে দুধের মান কমেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে মণ্ডার স্বাদেও।
মুক্তাগাছার আদি ও অকৃত্রিম গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন রাজা, মহারাজা ও জমিদার বাবুদের আর্থিক আনুকুল্য, আন্তরিক সহযোগিতা ও সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর বাড়ির পূর্ব দিকে নির্মিত হয় মণ্ডার দোকানের এ দালান ঘরটি।
অনেকেই মণ্ডার স্বাদ, বৈচিত্র্য আর গন্ধ নিযে আগে প্রশংসায় গদগদ করতেন। কিন্তু এখন প্রেক্ষাপট অনেকটাই বদলে গেছে। মণ্ডা মুখে তুলে প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন এর স্বাদ-ঘ্রাণ নিয়ে।
মুক্তাগাছার আদি ও অকৃত্রিম গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানে সপরিবারে মণ্ডামুখ করতে এসেছেন ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে সারোয়ার আলম।
মণ্ডার স্বাদ-ঘ্রাণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এক সময় এ মিষ্টান্নের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ছিল। এখন এ জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। পাতলা ওয়েল পেপারে মোড়ানো মণ্ডার গন্ধ এসে লাগতো নাকে। এখন তেমনটি আর পাওয়া যায় না।
ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন এখনো লোকজন আসেন গোপাল পালের দোকানে মণ্ডার স্বাদ নিতে। কিন্তু আগের স্বাদ-গন্ধটা কেন জানি অনেকটাই উবে গেছে। এক সময়কার বাজার মাতানো মনভরানো এ মণ্ডা ক্রমশ ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে মত দেন এ দোকানে মণ্ডা কিনতে আসা সাইদুর রহমান, নার্গিস আক্তারসহ বেশ কয়েকজন ক্রেতা।
বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় মণ্ডা মিঠাই শিল্পী গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর রবীন্দ্র নাথ পাল ও রথীন্দ্র নাথ পাল এর। আগের সঙ্গে বর্তমান মণ্ডার স্বাদের পার্থক্যের বিষয়টি একেবারে অস্বীকার করেননি তারা।
মণ্ডার স্বাদ ও গন্ধ মূলত দুধ আর চিনির উপর নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র নাথ পাল বলেন, দেশি গরু থেকে এখন আর দুধ সংগ্রহ করা হয় না। এখন বিদেশি গাভী থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। চিনি এবং দুধের গুণগতমান খারাপ হলে মণ্ডার স্বাদ-ঘ্রাণে কিছুটা হেরফের হতে পারে।
এ নিয়ে মুখ বিষ করে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ করেন। এ করেসপন্ডেন্টকে উপদেশ দিতেও ভোলেননি বর্ষীয়াণ রবীন্দ্র নাথ। বলেই ফেলেন, মণ্ডার ভাল দিক নিয়ে কথা বলুন। এসব সাইড নিয়ে লেখালেখি করার দরকার কী!
প্রয়াত গোপাল পাল থেকে পঞ্চম পুরুষ- এ কারণে স্বাদেও পরিবর্তন এসেছে কীনা জানতে চাইলে এবার চিবুকে রহস্যের হাসি দিয়ে রবীন্দ্র নাথ পাল দাবি করেন, ফর্মুলা একটাই। হাত বদলের ফলে স্বাদে কোন পার্থক্য হয় না।
একই রকম কথা জানান রবীন্দ্র নাথ পালের ছোট ভাই রথীন্দ্র নাথ পালও। তার ভাষ্যে, আগের মতো গরুর দুধের কোয়ালিটি নাই। এ কারণে মণ্ডার স্বাদে একটু পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু একবার যে মণ্ডার স্বাদ নিয়েছে তাকে এ সুস্বাদু মণ্ডা বার বার টানবেই।
তবে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মণ্ডা কারিগররা আগে স্থানীয় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দুধ সংগ্রহ করে নিজেরাই ছানা তৈরি করতেন। এখন তারা হয়ে গেছেন বাণিজ্যিক। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার দিয়ে ছানা কিনে আনেন। গোপাল পালের লাকড়ির সেই চুলায় এখন গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন তারা।
এছাড়া ফ্রিজে রেখেও তারা বাসি মণ্ডা বিক্রি করেন বলেও নানা রকমের কথাবার্তা গোটা উপজেলায় পথ চলতেই শোনা যায়। এসব কারণে মণ্ডার-স্বাদ-ঘ্রাণে আমুল পরিবর্তন এসেছে। ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কায় স্থানীয়রা এ নিয়ে কোন কথা বলতে চান না।
তবে মণ্ডার আবিষ্কারক গোপাল পালের পঞ্চম বংশধররা মণ্ডা তৈরিতে শুধু বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণে ক্রমশ কিংবদন্তি এ মণ্ডার গৌরব হারাতে বসেছে বলেও মনে করেন স্থানীয়রা।
সূত্র জানায়, গত মাহে রমজানে গোপাল পালের আদি ও অকৃত্রিম মিষ্টান্ন মণ্ডার কারখানায় অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওই সময়কার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি) জসিম উদ্দিন অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মণ্ডা প্রস্তুতের জন্য তাদের ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
মণ্ডার স্বাদ-ঘ্রাণের রকমফের হলেও কমছে না মণ্ডার দাম। প্রতি বছরই মণ্ডা মালিকরা নিজেদের ইচ্ছামতো মণ্ডার দাম বাড়াচ্ছেন। এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। স্থানীয় প্রশাসনও এ বিষয়ে একেবারেই নির্বিকার।
সূত্র মতে, জরুরি সরকারের সময়ে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) টিপু সুলতান মণ্ডা কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে প্রতি পিস ১২ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেন। এরপর বছর ঘুরতেই আবারো দাম বাড়ান তারা। বর্তমানে এ মণ্ডা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা পিস দরে। এক্ষেত্রে মণ্ডা সংশ্লিষ্টরা দুধ ও চিনির দাম বাড়াকেই দায়ী করেছেন।
মণ্ডা তৈরির কলাকৌশল যেমন টপ সিক্রেট, তেমনি প্রতিদিন কী পরিমাণ মণ্ডা তৈরি হয় তা নিয়েও কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করেন মণ্ডা মালিকরা। তাদের হিসেবে নিত্য ২৫ থেকে ৩০ কেজি মণ্ডা উৎপন্ন হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
কয়েক দফা মণ্ডার দোকানে গিয়ে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে দেখা গেলো, প্যাকেটের পর প্যাকেট মণ্ডা বিক্রি হচ্ছে। দলে দলে লোকজন আসছেন মণ্ডার স্বাদ নিতে। এতে করে দিনের প্রথম প্রহরেই তাদের হিসেবের মণ্ডা ফুরিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, ভ্যাট ফাঁকি দিতেই মণ্ডার সঠিক হিসাব নিয়ে ছলচাতুরি করেন কারিগররা।
এসব বিষয়ে গোপাল পালের বর্তমান উত্তরসুরি মণ্ডা কারিগর রথীন্দ্র নাথ পাল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা কারখানাতেও ছানা তৈরি করি। আবার বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের লোকেরাই ছানা তৈরি করে নিয়ে আসেন। আমাদের ছানা তৈরির প্রসেস তাদের শিখিয়ে দিয়েছি।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের বিষয়ে দাবি করেন, কারিগরদের হাতে ওই সময় গ্লাভস ছিল না। এ কারণে মাত্র ৩ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হয়েছিল। আর অর্ডার থাকলে বেশি মণ্ডা তৈরি করা হয়, বলেন রথীন্দ্র নাথ পাল।
** দেশসেরা ছানা-চিনিতে মুক্তাগাছার মণ্ডা
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৫
জেডএম