রংপুর থেকে ফিরে: বাবার পিটুনি খেয়ে রাগ করে মামার বাড়ি চলে যান মমিনুল হক। চারদিন পরের ঘটনা।
গৌতম তাকে (মমিনুল) ডেকে বিদ্যুতের লাইনে ঝুলে থাকা একটি গাছের ডাল কেটে দিতে বলেছিলেন। বিষন্ন মমিনুল প্রথমে এতে আস্বীকৃতি জানান। পরে তাকে অর্থের লোভ দেখানো হয়। আর এতেই প্রলুব্ধ হয়ে পড়েন মমিনুল। ওই মুহূর্তে তার প্রলুব্ধ হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
অভিমানী মমিনুলের মাথায় তখন কোন দিনই বাড়ি না ফেরার ভাবনা প্রবলভাবে চেপে বসেছিলো। আর মাথায় চেপে থাকা ভাবনা বাস্তবায়নে তার কাজ প্রয়োজন ছিল। একে সুযোগ হিসেবে দেখে রাজি হয়ে যান মমিনুল।
মই দিয়ে উঠে যেই গাছের ডালে হাত দিয়েছেন, তারপর আর কিছুই বলতে পারেন না। পরদিন নিজেকে আবিষ্কার করেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে। অসহ্য যন্ত্রণা তার পুরো শরীরে। বাম হাতটি পুরোপুরি ঝলসে যাওয়া।
যখন ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা মনে করার চেষ্টা করছিলেন তখনই রুমে আসেন ডাক্তার। শোনান জীবনের সবচেয়ে বড় দু:সংবাদটি। বলেন, তাকে বাঁচাতে হলে বাম হাত পুরোপুরি কেটে ফেলতে হবে। আর ডান হাতের কয়েকটি আঙ্গুল ফেলে দিতে হবে।
তখন কথা বলার মতো শক্তি ছিল না তার। এরপর পরই তাকে নেওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। অপারেশন থিয়েটার থেকে প্রতিবন্ধী হয়ে ফেরেন হাসপাতালের বেডে। তারও ২০ দিন পর বাড়ি ফেরেন মমিনুল। শুরু হয় যন্ত্রণার জীবন।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকে তাকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। নাবালক হিসেবে তার বাবা মন্টু মিয়া (ট্রাক চালক)টাকা গ্রহণ করেন। এতে মমিনুলের ছিল প্রবল আপত্তি। তিনি চেয়েছিলেন তার নামে একাউন্ট করে টাকা দেওয়া হোক। না হলে এই টাকা তার কাজে আসবে না। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির লোকজনকে অনুরোধও করেছিলেন। কিন্তু তার সেই অনুরোধ রাখেনি রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১। পরে মমিনুলের ধারণাই সঠিক হয়েছে।
দিন তারিখ ঠিকমতো বলতে পারেন না, তবে সাল মনে আছে ২০০৬। আর মাসটি ছিল রমজান। এরপর অনেক ঈদ এসেছে গেছে, কিন্তু ঈদে আনন্দের ছোঁয়া পাননি মমিনুল। পুরো জীবনটাই তার কাছে দুর্বিষহ। গোসলের পর কাপড় বদলে দিতে হলেও তাকে অন্যের সাহায্য নিতে হয়।
তাকে সহায়তা করার জন্য বিয়ে করিয়ে দেয় পরিবারের লোকজন। স্থানীয় সাংবাদিক সরওয়ার জাহান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অনেক তদবির করে প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য অন্তর্ভুক্ত করেন মমিনুলের নাম। সেখান থেকে মাসে পাঁচশ’ টাকা পান। এই টাকা দিয়ে সংসার চলে! চলে না। আর চলে না বলেই তাকে ছেড়ে চলে যান স্ত্রী।
এবার স্থানীয় সাংবাদিকদের পরামর্শে পত্রিকার হকারি শুরু করেন। দ্বিতীয় বিয়েও করেন। এখন তার সংসারে দু’টি ফুটফুটে সন্তান। বড় মেয়ে তানজিনা আক্তার মাহি (৫)ও ছেলে আপনকে (১) নিয়ে তার সংসার।
পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পত্রিকা পৌঁছুতে দুপুর গড়িয়ে যেতো। দেরি করে পত্রিকা দেওয়ার কারণে অনেকে তাকে না করে দেন। দিন দিন তার ব্যবসা গুটিয়ে যেতে থাকে। আর পায়ে হেঁটে পত্রিকা বিলি করতে তার খুব কষ্টও হতো। তাই ধার দেনা করে একটি বাইসাইকেল কিনেছিলেন।
কিন্তু তার সেই সুখ বেশিদিন সহ্য হয়নি বিদ্যুতে পোড়া কপালে। বিএনপি জোটের টানা ৯০ দিনের অবরোধে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে তার স্বপ্নের বাহনটি। অবরোধের সময় গাড়ি বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে পত্রিকায় যাওয়া বন্ধ থাকে। কতটুকুইবা তার মূলধন। সেই মূলধন খাওয়া শেষে অভাবের তাড়নায় সাইকেলটি বিক্রি করতে বাধ্য হন।
নি:স্ব বলতে যা বুঝায় মমিনুল হকের অবস্থা এখন পুরোপুরি তাই। ঘরের জায়গাটুকু ছাড়া তার কোন আবাদি জমি নেই। পত্রিকা বিক্রির পাশাপাশি বসত ঘরেই খাঁচার মধ্যে কয়েকটি হাঁস ও মুরগী পালন করেন। এই দিয়ে অনাহারে অর্ধহারে দিন কাটছে তার। মেয়েটিকে স্কুলে ভর্তি করাতে চান। কিন্তু খরচ যোগাতে পারবেন কি-না- সে নিয়ে মহাচিন্তায় রয়েছেন।
ঘরের সঙ্গেই আখিরা নদী। সেই নদীতে অনেকেই হাঁস পালন করে সুখের সংসার গড়েছে। মমিনুলও স্বপ্ন দেখেন হাঁস-মুরগীর খামার তৈরির। কিন্তু এ জন্য খামারের ঘর তৈরির সামর্থ তার নেই। ব্যাংকে যোগাযোগ করেছিলেন ঋণ নেওয়ার জন্য। তারাও নিরাশ করেছে।
মমিনুলের এমন হওয়ার কথা ছিল না। আর দশটা মানুষের মতোই ছিল তার জীবন। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যানের খামখেয়ালীর কারণে আজ সে প্রতিবন্ধীর তালিকায়। কেননা বিদ্যুতের লাইনে ঝুলে থাকা গাছের ডাল কাটতে হলে আগেই ওই লাইনের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়।
কিন্তু মমিনুলের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। যে কারণে আজ মমিনুলের এই করুণ পরিণতি। কিন্তু যাদের কারণে এই পরিণতি তারা আজও বহাল তবিয়তে। তারা আর এক দিনের জন্যও মমিনুলের খোঁজ নিতে আসেনি। এখানেই যেন মমিনুলের সবচেয়ে বেশি আক্ষেপ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৫
এসআই/জেডএম