ঢাকা: মানুষ নিজেই তার পরিবেশ ধ্বংস করছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে হাজার হাজার বছর ধরে।
পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ভূগোল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এরফানুল হক সোয়েব বলেন, মানব সভ্যতার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পরিবেশ ধ্বংসের ইতিহাস। তবে সে সময় প্রয়োজনের তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদে পৃথিবী পরিপূর্ণ থাকায় কেবল প্রয়োজন মেটানোর সে ক্ষয়ক্ষতি কারো নজরে পড়েনি’।
তিনি বলেন, ‘মানুষ তার প্রয়োজনে গাছ কেটেছে। তা এখনো চলছে। পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছে। গুহা খুঁড়ে পরিবেশের আদল পাল্টিয়েছে, খনি খুড়ে অভ্যন্তরের পরিবর্তন সাধন করেছে। বিভিন্ন মারণাস্ত্র তৈরির মাধ্যমে বাতাস, পানি ও মাটিকে দুষিত করেছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন পৃথিবীর সেই অফুরন্ত সম্পদের ভাণ্ডার নেই। অদূরদর্শী মানুষ তাই আরো বেশি চতুর ও লোভী হয়ে উঠেছে। শক্তি উৎপাদন, যুদ্ধ, বাসস্থান, আসবাব, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য, বিনোদন, সব ক্ষেত্রেই আঘাত আসছে প্রকৃতির ওপর। ’
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) সদ্য প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়- ১৯৭৭-৯৮ সাল পর্যন্ত গত ২২ বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর কক্সবাজারে ৭ দশমিক ৮৮ মিলিমিটার, হাতিয়ারচর ডাঙ্গায় ৬ মিলিমিটার ও হিরণ পয়েন্টের কাছে ৪ মিলিমিটার করে বেড়ে যাচ্ছে।
এছাড়া ২৪টি আবহাওয়া স্টেশনে সংগৃহিত ৩০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বার্ষিক গড় হিসেবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রতি বছরই একটু একটু করে বাড়ছে। একই সঙ্গে সর্বনিন্ম তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। বার্ষিক গড় তাপমাত্রায় ঊর্ধ্বগতির ফলে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিধি আশংকাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
এসএমআরসি’র এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২০৫০ সাল পর্যন্ত ০.৪১ ডিগ্রি হারে বাড়তে থাকবে। একইভাবে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতও ২০৫০ সাল পর্যন্ত ২৯৬ মিলিমিটার ও ২১০০ সাল পর্যন্ত ৫৩৪ মিলিমিটার হারে বাড়বে। এ সময় পানির এত পরিবর্তন ঘটার ফলে প্লাবন ও জলাবদ্ধতার মাত্রা বাড়বে, ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানিতে এবং মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে বলেও পূর্বাভাস প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, ভূমিক্ষয় ও নতুন ভূমি জেগে ওঠাসহ উপকূলীয় ভূ-প্রকৃতিতে পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রাও বেড়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমুদ্রপৃষ্ঠে মাত্র ১ মিটার উচ্চতাকে মোকাবেলা করার খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বা এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জলবায়ূগত পরিবর্তনের ফলে তৈরি নানা সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ উপকূলবাসী। তাদের পুনর্বাসন করার খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা বা ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আর এক হিসেবে দেখা গেছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মাথাপিছু ১২ ডলার করে মোট প্রয়োজন হবে প্রায় ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের দরকার হবে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে এর প্রভাবে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি কমে যেতে পারে ২৮ থেকে ৫৭ ভাগ।
এদিকে টঘঊচ-এষড়নধষ ডধৎসরহম রহ অংরধ রিপোর্ট এ বলা হয়েছে- বিগত তিন দশকে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র স্তর ৫.৫ মি.মি. বৃদ্ধি পাওয়াতে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ একর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট প্লাবিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে সমুদ্র স্তর ১ মিটার বৃদ্ধি পাবে।
এতে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম, সন্ধীপ ও ক´বাজারের অনেকাংশ সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যাবে এবং দেশের ভেতরের অনেক জেলায় বন্যা বৃদ্ধি পাবে।
এতে আরও বলা হয়, উপকূলীয় এলাকায় মানুষ, পশুসম্পদ, ফসলাদিও গাছ-পালাসহ অন্যান্য অবকাঠামোও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সার্ক মেট্রোলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের (ঝগজঈ) জরিপ ও গবেষণা এবং নাসা কর্তৃক পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে যে হারে বাংলাদেশের উষ্ণতা বাড়ছে সে হারে অব্যাহত থাকলে চলতি শতকেই সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, পৃথিবী বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও ৯ টি উপকূলীয় জেলা সহ বাংলাদেশের ১৬ ভাগ এলাকা তলিয়ে যাবে। এতে প্রাণহানি ঘটবে ২ কোটি ৪ লাখ মানুষের। ক্ষতি হবে ৪৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ।
অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়াঃ তুলনামূলক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের কার্যপত্রে প্রকাশিত নিরীক্ষায় দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাত্র এক মিটার বাড়লে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ তার জিডিপিতে সর্বোচ্চ দশমিক ৭ শতাংশ ক্ষতির শিকার হবে। যদি ৫ মিটার বাড়ে তবে বাংলাদেশে জিডিপির ৯ শতাংশ ক্ষতি হবে।
জনসংখ্যাগত ক্ষতির পরিমাপে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ভূমির হিসেবেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ হবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় অনেক বেশি ১১ শতাংশ এলাকা হারাতে হবে যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
কৃষিখাতে বাংলাদেশকে ১০ শতাংশ ক্ষতির শিকার হতে হবে বলে কার্যপত্রে বিশেষজ্ঞরা আরও বর্ণনা করেন।
পরিবেশের এ বিপর্যয় কেবল বাংলাদেশের জন্যই বা মানুষের জন্যই ক্ষতিকর নয়। পরিবেশ বিপর্যয় বিলুপ্ত করছে প্রাণীকুলকেও। কেবল বাংলাদেশ থেকেই এরমধ্যে হারিয়ে গেছে ১৮ প্রজাতির প্রাণী। জাতিসংঘের ভাষ্য মতে, মানব প্রজাতি আর মিলিয়ন মিলিয়ন জীবজগত একত্রে পৃথিবীকে অধিকতর নিরাপদ রাখতে পারে। কারন জীবজগত রক্ষা করা ছাড়া আমাদের পৃথিবী বিবর্ণ।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৫-১০০ মিলিয়ন প্রজাতির জীব আছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তার মাত্র ২ মিলিয়ন খুজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবীর আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত সব প্রাণীকূলের মধ্যে মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অথচ ধ্বংস হচ্ছে অন্যান্য প্রাণীকূল।
পরিসংখ্যানে আরও বলা হয়, ১৭হাজার ২’শ ৯১টি জীবপ্রজাতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এ বিলীণ হতে যাওয়া প্রাণীকূলের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। আর এসবের পিছনে সরাসরি হাত রয়েছে মানুষের ।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এ সম্পর্কে এক বার্তায় সতর্ক করেছেন সবাইকে। তিনি বলেন, ‘জীবপ্রজাতি বিশ্বজুড়ে হুমকির মুখে। রেকর্ডসংখ্যক জীব প্রজাতি খুব দ্রুত নিশ্চিহ্নের পথে। এসবের সাথে যোগ হচ্ছে দূষিত পানির সমস্যা। ’
তিনি বলেন, ‘এসব হুমকি মোকাবেলা ও প্রাণী জগত রক্ষায় আচরণ পরিবর্তন খুব জরুরি। ’
জাতিসংঘের উপ-মহাসচিব এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক অসিম স্টেইনার এ বিষয়ে বলেন, ‘জীবজগতের ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের কারণে পৃথিবী প্রতিবছর অঘোষিতভাবে ২-৫ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়ছে। ’
নাসার অর্থায়নে পরিচালিত আমেরিকান জিওফিজিকাল সোসাইটির একদল বিজ্ঞানী গবেষনায় দেখেছেন, গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে উত্তর মেরুর বরফ গলে যাওয়ার পর আবার স্বাভাবিক মাত্রায় বরফ জমছে না। উত্তর মেরুর সাগরে ২০১০ এর সেপ্টেম্বরে বরফের পরিমাণ ছিল ৫.৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। সেখানে প্রতি দশ বছর ৮.৫৯ শতাংশ বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছর কমছে প্রায় ৬০ হাজার ৪২১ বর্গকিলোমিটার বরফ।
এ হারে চলতে থাকলে উত্তর মেরুতে ২০৬০ সালের পর কোনো বরফই অবশিষ্ট থাকবে না বলে জানিয়েছেন কলোরাডো ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ ড. মার্ক সেরেজ।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, বর্তমানে পরিবেশের উপর যে ধবংসাতœক কার্যক্রম চলছে তা যদি অব্যাহত থাকে তবে পৃথিবীতে গত শতাব্দীতে সমুদ্র স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ সেন্টিমিটার। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন সমুদ্র স্তর বৃদ্ধির এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশসহ বিশ্বের সমুদ্র উপকূলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পারিমাণ দাঁড়াবে ৫০০-৭০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), যা বর্তমানে ৩৫০ পিপিএম।
এতে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে প্রকৃতিতে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেবে।
ইউনাইটেড নেশন ইনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) এর সমীক্ষা অনুযায়ী এর ফলে অনেক দেশের ছোট ছোট দ্বীপ সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যাবে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সাল নাগাদ-পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী পানি সংকটের মধ্যে বসবাস করবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাবে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৫ ঘন্টা, ০৫ জুন, ২০১১