বকশীগঞ্জ, জামালপুর থেকে: তাদের মনে যেমন প্রেমের ঘাটতি নেই, তেমনি রক্তক্ষরণও কম নয়। কিন্তু সাধারণ ইটের দেয়াল এই ভালবাসা, শোক কিংবা অসভ্যতার ভার বইবে কীভাবে সেটাই ভাবছিলাম!
প্রেমিক+প্রেমিকা এই ফরমেটে দু’জনের নাম বসিয়ে কোনো দেয়াল বা গাছকে সাক্ষী রাখার চেষ্টা হাজার বছর না হলেও যে শত বছরের পুরনো সেটা অনুমান করি।
লাউচাপড়া পাহাড়িকা অবকাশ কেন্দ্র জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। দুই সহকর্মীসহ অবকাশ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ উঁচুতে উঠতে থাকলাম। টিলার মাঝে মাঝে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় কয়েকশত ফুট ওপরে ওঠা। শীর্ষ চূড়ায় উঠতে হলে পাঁচ তলা উঁচু টাওয়ারের চূড়ায় উঠতে হবে আমাদের।
আগের সন্ধ্যায় বন্য হাতির পালের তাড়া খাওয়ায় আমাদের শরীর এখন আরও বেশি কষ্টসহিষ্ণু। তাই ছোট ছোট নিঃশ্বাসে হাঁপাতে হাঁপাতেই একেবারে শীর্ষে।
এতোক্ষণে টিলাগুলোকে কিছুটা পাহাড়ের মতো মনে হলো। দূরে মেঘালয়ের পাহাড় আমার মনেও কবিত্ব তৈরি করতে চাইলো। লিখবো কোথায়? পকেটের নোটবুকে তো রিপোর্টিংয়ের নোট নেওয়া হয়, কবিতা লেখার জন্য না। অগত্যা আমার পূর্বপুরুষ কবিদের মতোই আমিও টাওয়ারের দেয়ালে লেখার জন্যে শিষ কলমের ক্যাপ খুললাম।
মনের মধ্যে যৌবনের প্রেম যেন আবার ঝিলিক মেরে উঠলো। একি আমার অপেক্ষাতেই কি কেউ লিখে রেখেছেন, ‘তোমারি অপেক্ষায় আছি’! শক্ত করে আঙুলে চেপে ধরলাম আঙুল। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। ‘বিএস’ নামে হয়তো ‘বেহুলা সুন্দরী’ শত বছর পূর্বে আমার অপেক্ষায় থেকেই এ কথা লিখে রেখে গেছে। নিজের মধ্যে পাপবোধ কাজ করতে শুরু করলো। ‘কেন? কেন? আমি এতো দেরিতে বকশিগঞ্জ আসলাম। ’ কেনই বা শুধু শুধু লক্ষ্মীন্দরকে বাঁচাতে গেল বেহুলা। আসলে মনের ভেতরে ভেতরে আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি।
একটু বামে তাকাতে চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলাম না। দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। কে যেন গোটা গোট অক্ষরে লিখেছিল, ‘তোমার সাথে মনে হয় আর দেখা হবে না’। প্রিয় বা প্রিয়াকে হারাতে কি কষ্টটাই না হয়েছে তার। দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললাম। বেশিক্ষণ দুঃখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না এখন আর। অভিনেতা মোশাররফ করিমের মতোই ‘আবেগে কাইন্দা ফেলি’।
ওরে বাবা! চোখ ফেরাতেই এক বীরপুরুষের লেখা চোখে পড়লো। কি সাহসী উচ্চারণ! ‘আই লাভ ইউ শাম্মি’। শাম্মিকে ভালবাসার সাক্ষী রেখেছেন এই দেয়ালকে। জানি না বেচারার এই প্রেম নিবেদন বা প্রকাশ চোখে পড়েছে কিনা শাম্মির।
এবার কিন্তু থমকে গেলাম। চোখের সামনে রক্তপাতের চিহ্ন। হয়তো আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে এই ত্রিভুজ প্রেমের কথা! বেঞ্চের মতো বসার স্থানে মাহবুব+নজরুল+জেসমিন। নাহ ত্রিভুজ প্রেম মনে হয় না। কোনো নায়ক তার প্রেমিকার পাশে আরেকজন নায়কের নাম বসাবে না। তবে কি বেচারি জেসমিনই এ কাজ করেছেন? নিজের রক্ত দিয়ে নিজের দুই প্রেমিকের নাম লিখে গিয়েছেন।
এই প্রেমের সিনের প্লেব্যাক গান হচ্ছে জেসমিনের কণ্ঠে, ‘বিধি তুমি বলে দাও আমি কার, দু’টি মানুষ একটি মনের দাবিদার‘।
যদি লাল রংয়ের মার্কার কলমের বদলে সত্যিই রক্ত দিয়ে এ কারুকাজ করা হয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই জেসমিনকে পরে বেশ কয়েকমাস রক্তশূণ্যতায় ভুগতে হয়েছে।
পলাশ নিজের নামের যোগ চিহ্নের সঙ্গে শুধুই ‘এস’ জোড়া লাগিয়েছেন। এমনও হতে পারে, পলাশের এস অক্ষর দিয়ে অনেকগুলো বান্ধবী ছিল। যাকেই এখানে নিয়ে এসেছে, হয়তো বলেছেন, তোমার জন্যেই আমার এ শিল্পকর্ম। এই টাওয়ারের দেয়াল স্বাক্ষী রেখে তোমাকে ভালবেসেছি আমি। সাংবাদিকদের পক্ষে কি ভাল চিন্তা আসে না! আরে ভাই পলাশের বাড়ি এখানে। এখানে ঘুরতে এসে তার পরিবারের কেউ মেয়েটার নাম জেনে যেতে পারে, তাইতো শুধু একটি অক্ষর ব্যবহার করেছেন, সাথী বা শাকিলা অথবা শাম্মী কিংবা ভিন্ন কারও।
পঞ্চম তলায় আর দাঁড়াতে পারলাম না। আবেগ সংবরণ করে এক ফ্লোর নিচে নেমে আসলাম। দেয়ালের ছাদের অংশে এক প্রেমিক ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ভালবাসা শুধু তোমার জন্য জুই’। এটা লম্পট প্রেমিকের লেখা, ধরে নেওয়া যায়। কারণ সে অন্য মেয়েদের সঙ্গেও তলে তলে প্রেম করতো। এরপর জুইকে বিশ্বাস করানোর জন্যে এই ওয়ালে ঝুলে লেখাটা লিখেছে। মাথা নেড়ে ধিক্কার দিলাম লম্পটটাকে।
বারবার মেয়েদের ধোঁকা খেয়েছেন এক ভাই। আর কাকে বিশ্বাস করবেন তিনি? দুঃখে, কষ্টে পাথর হয়ে কোনো রকমে টাওয়ারের চারটি পিলারের একটিতে অন্যসব প্রেমিকদের উদ্দেশে জীবনের শেষ বাণী দিয়েছেন তিনি এই বলে, ‘গার্লস অলওয়েজ ব্রেক ইউর হার্ট’। আহা রে! কী কষ্টটাই না জমা ওই পুরুষের বুকে।
এক সাকিব কতজনকে ভালবেসেছেন! যদি দু’জনও হয় তবে যেই প্রেমিকা নিয়ে আসবেন, তিনিই ধরা খাবেন। কারণ একটি দেয়ালে লিখা সাকিব+রুজিনা। আরেকটিতে শাকিব+সানজিদা। এটা কি একজন সাকিব? নাকি দু’জন ভিন্ন ব্যক্তি। ভাবিয়ে তোলে আমায়।
ভুলটা হয়েছে আমারই। একজন কবি হিসেবে আমার অবশ্যই উচিৎ ছিল মার্কার কলম সঙ্গে রাখা। এই যে কী সুন্দর করে রাকিব লিখেছেন, ‘মন তো কাঁচ নয় তবু সে ভেঙে যায়, সুখতো পাখি নয় তবু সে উড়ে যায়.....’। দীর্ঘ কবিতা। এইতো সত্যিকারের কবি। কী করতে পারলাম আমি জীবনে, রাগে-ক্ষেভে শিষ কলমটাকে পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিই নিচে।
শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার সাক্ষী হবে দেয়াল, তা কেন? এইতো নবীন লিখেছেন, ‘এ লিটল নলেজ ইজ এ অলওয়েজ ডেঞ্জারাস থিংস। ’ নবীনকে মনে হয় বাইরে ভাল কথা বললে দুষ্ট লোকেরা মারেন। তাইতো এই নিরিবিল জায়গায় এসে সুন্দর করে দেয়ালে দিয়েছেন উপদেশ। মানুষকে বেশি জেনে কথা বলার অনুরোধ করেছেন তিনি। আরে ভাই এতোটুকু তো বুঝি।
শুধু লাউচাপড়া কেন, দেশের প্রতিটি দর্শনীয় স্থানেই এ ধরনের দেয়াল লেখক শিল্পী এবং প্রেম যুগলের ভালবাসার কথা পাওয়া যাবে। তবে ভালবাসার এসব দেয়ালে ধর্ষকরাও প্রচুর লিখে বেড়ান। যেমন এই লাউচাপড়াতেও বেশ কয়েক জায়গায় মেয়ের নামে পরে ‘চু..’ বা ‘চো...’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের ধর্ষক মনের পরিচয় দিয়েছেন পুরুষেরা। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা কোন মেয়েকে অসম্মান করার জন্যে গালি দিয়ে কোনো কথা দেয়ালে লেখা, ধর্ষক মনেরই পরিচয় দেয়, সেটা তো বোঝা যায়। অসভ্যতার সাক্ষীও হতে হয় দেয়ালটিকে।
প্রতিটি ফ্লোরে ফ্লোরেই সুখী, ব্যর্থ আর ধর্ষক প্রেমিকদের মনোবাসনা, মনের কথা আর ক্ষোভ ফুটে উঠেছে। দেয়ালের সৌন্দর্য এখানে গৌণ বিষয়। হোক না পর্যটন কেন্দ্র। তাই বলে আমরা সবাই তো আর কলম ছুঁড়ে ফেলতে পারি না। লিখে যেতে হবে মন মতো, বাসের সিটের পেছনে, দেয়ালে, ক্লাসের বেঞ্চে সবখানে।
** তদন্তে পূর্ব পরিকল্পনার ছাপ
** ময়নাতদন্তে বর্বরতার চিহ্ন
** হাতি তাড়ানোর প্রশিক্ষণ নেই মাখনেরচরবাসীর
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৫
এমএন/এইচএ/