খুলনা: হেমন্তের প্রভাতে মাকড়সার জালের শিশির কণা যেন হিরন্ময়ী দ্যুতি। অপরূপ এ দৃশ্য কৌতূহলী মনকে সচকিত করে তোলে অনায়াসে।
প্রকৃতির কারিগররূপী মাকড়সা মালার মতো যে জাল বুনেছে তাতে হেমন্তের শিশির বিন্দু বিন্দু আকারে জমে প্রকৃতি-সুন্দরীর খোঁপায় যেন এক অসাধারণ অলঙ্কার গড়ে তুলেছে। কিন্তু এ অলঙ্কার ক্ষণস্থায়ী। ভোরের সূর্যের কাছে পরাস্ত হয়ে অভিমানী শিশির নেয় বিদায়। যান্ত্রিক শহরের ইট-পাথরের মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকদের ক’জনেরই বা এমন দৃশ্য সচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছে!
ধান ক্ষেতে শিশির বিন্দু:
‘বহুদিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু। ’ – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রভাতে ধানের শীষে ও ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু হেমন্তের বার্তা নিয়ে এসেছে বাংলার প্রকৃতিতে।
হেমন্তের অলস সূর্যটা:
হেমন্তের অলস সূর্যের রোদের তাপে নেই সেই রাগী উত্তাপের ছোঁয়া। হিম হিম ঠাণ্ডা আমেজ জড়িয়ে রয়েছে। রাতের কালো আকাশ চিরে নিঃশব্দে নেমে আসছে কুয়াশার চাদর। ভিজিয়ে দিচ্ছে গাছপালা, রাস্তার মানুষ, অলিগলি, ফসলের মাঠ। ভোরবেলাতে খিড়কি খুলেই হিম ভেজা বাতাসের ধাক্কা চোখে মুখে। কুয়াশা মোড়ানো চরাচর যেন ঘষা কাচের ওপারের দৃশ্যাবলি। অস্বচ্ছ, অপার্থিব। অস্পষ্ট বৃক্ষরাজি, খালবিলের জল, পূর্ব আকাশে উঁকি দেওয়া সূর্যটাও আড়াল।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে, মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার, চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ’।
আমন ধানের সোঁদা গন্ধে ভরে উছেঠে আবহমান বাংলার হেমন্ত সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যায়-রাতে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে নিশির শিশির। নারিকেলের চিরল পাতার শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে হেমন্তের ক্লান্তি।
কৃষকের চোখে-মুখে চিকচিকে হাসি:
হেমন্তে মাঠে মাঠে শিশির ভেজা সোনালি ধানের বাহার। কোথাও কোথাও পাকা ধানের ভারে নুইয়ে পড়েছে গাছ। যা কৃষকের চোখে-মুখে-ঠোঁটে চিকচিকে হাসি এনে দিয়েছে। বর্ষার দীর্ঘ-অনিশ্চিত কর্মহীন-রোজগারহীন সময়ের ধকল পেরিয়ে আনন্দময় দিনের আগমন। কেউ কেউ উত্সবের মতো করে শুরু করেছে ধানকাটার আয়োজন। কৃষকের উঠান ভরে উঠেছে ধানে। এমনকি যাদের জমিজমা নেই তারাও এখন খুব ব্যস্ত, অনেক কাজ তাদের। ধান কাটা, রাত জেগে ধান মাড়াই করা, শুকিয়ে সেদ্ধ করে ভাঙানোর উপযোগী করা। কত কত কাজ তাদের।
মায়াময় হেমন্ত:
আহা, হেমন্ত! তার সবকিছুই বড় মৃদু অথচ মায়াময়। গ্রীষ্মের বা শীতের তীব্রতা তার নেই, নেই বর্ষার তুমুলতাও, বরং সে এসেছে শীতের আগমনবার্তা নিয়ে, দীর্ঘ গরমের পর আরামদায়ক শীতল হাওয়া নিয়ে, অল্প সময়ের জন্য। আকাশে পাতাঝরা দিনের বিষণ্ণতার আনাগোণা, মন খারাপ করা বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে নেমে আসছে মৃদু শীতমাখা অপরূপ উদাসীন সন্ধ্যা। সন্ধ্যার মতো ভোরও ফুটে ওঠে মৃদু কুয়াশা মেখে, মখমলের মতো নরম ঘাসগুলো শিশিরে ভিজে থাকে সামান্য সময়ের জন্য। আর এই শিশিরে ভিজে অপরূপ হয়ে ওয়ে বুনোফুল। সকালের মিঠে রোদে অতিদ্রুত হারিয়ে যায় সবকিছুকে অপরূপ করা সেই অভিমানী শিশির।
সাদা কুয়াশায় ঢেকেছে পথ:
হেমন্তের খুব ভোরে চেনা রাস্তার অলিগলিগুলো এখন সাদা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। কাক ডাকা ভোরে হেঁটে চলা ফেরিওয়ালা কিংবা খেজুর গাছ কাটা গাছীকেও চেনা দায়। তবে সবচেয়ে সুন্দর নদীর বুকে কুয়াশার দৃশ্য। নদীর পানির উপর যখন কুয়াশাগুলো ভেসে বেড়ায় তখন মনে হয় কি যেন এক অশরীরী আত্মা পানির উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভোরের মৃদু-মায়াময় কুয়াশা, শিশির ভেজা কোমল-শীতল ঘাস, খালি পায়ে হেঁটে গেলে তাদের আদুরে স্পর্শ, শরীর জুড়ানো হাওয়া, বিকেলের মিঠে রোদ, সন্ধ্যার চরাচরব্যাপী উদাসিনতা, রাতের আরামদায়ক শীত, এসব নিয়েই এসেছে হেমন্ত।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৫
এমআরএম/এমজেএফ