ঢাকা: তখন গোটা ভিয়েতনাম জ্বলছে। ১৯৫৯ সালে দেশটিতে শুরু হওয়া দীর্ঘমেয়াদী সামরিক সংঘাতের একপক্ষে লড়ছে উত্তর ভিয়েতনামি জনগণ ও ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট।
১৯৭২ সালের ০৮ জুন। ভিয়েতনামের ট্র্যাং ব্যাং গ্রামে উড়োজাহাজ থেকে নাপাম বোমা (এক ধরনের পেট্রোল বোমা) ফেলতে শুরু করেছে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সৈন্যরা। মূল রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বার্তাসংস্থা এপি’র ফটোসাংবাদিক নিক উট। যে যেদিক পারে পালাচ্ছে। হঠাৎ নিক খেয়াল করলেন, আট-নয় বছরের একটি উলঙ্গ মেয়ে ‘ভীষণ গরম, আমি মরে যাচ্ছি’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে আসছে। মুহূর্তের আকস্মিকতায় চমকে গেলেও ফ্রেমবন্দি করতে ভুললেন না নিক।
তারপর বাকিটা ইতিহাস! ছবি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ভিয়েতনামে চালানো যুক্তরাষ্ট্রের রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধকে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যে ফেলে দেয়। অবিস্মরণীয় এ ছবির জন্য ফটোগ্রাফির সবচেয়ে সম্মানজনক খেতাব পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন নিক। ছবিটির নাম রেখেছিলেন ‘নাপাম গার্ল’। যতো সময় গড়িয়েছে ততো ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতীক হয়ে উঠেছে নাপাম গার্ল। বলা ভালো, জীবন্ত প্রতীক! জীবন্ত কেন?
কেননা নাপাম গার্লের সেই দৌড় কেবল ছবিতেই আটকে নেই। তার বয়স এখন ৫২। নাম পান থি কিম পুক। ১৯৬২ সালের ০২ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের ট্র্যাং ব্যাং গ্রামে তার জন্ম। ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তে ফ্রেমবন্দি হওয়ার দিন তার বয়স ছিলো নয় বছর। সেই থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পোড়া ক্ষত আর তীব্র যন্ত্রণা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন কিম।
হয়তো সেদিন অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে খেলছিলেন। হঠাৎ বোমা বর্ষণে ঝলসে যায় কিমের পিঠসহ হাতের একপাশ। আগুন ছড়িয়ে পড়ে জামাকাপড়ে। শেষে আগুন থেকে বাঁচতে এভাবেই কাপড় ছাড়া ছুটে বেরিয়ে আসেন।
সেই স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে, আমার মনে হচ্ছিলো আমি মরে যাচ্ছি। কী ভীষণ যন্ত্রণা!
এরপর কেটে গেছে কয়েক যুগ। এ দীর্ঘ সময় পোড়া ক্ষত ঢেকেছেন গা ঢাকা কাপড়চোপড়ে। কিন্তু যন্ত্রণাকে কোনোভাবে ধোঁকা দিতে পারেননি। একে সঙ্গী করেই পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে পাড়ি জমিয়েছেন কানাডা। স্বামী বুই হাই টোন আর দুই সন্তানসহ অন্টারিওর অ্যাজাক্সে থাকেন। পড়াশোনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব হাভানায়। কর্মজীবনে লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেন।
এতো গেলো কিমের কথা। আর নিক উট, যাকে কিম ডাকেন আংকেল উট নামে? হ্যাঁ, নিকের বয়স এখন ৬৫। নিকও কিমকে নিজের মেয়ে বলেই মানেন। যেখানেই থাকুন কেন, নিয়মিত ফোনে কিমের খোঁজ নেন। কিমও মনখুলে তাকে বলতে থাকেন তীব্র যন্ত্রণার কথা। তাকে বলবেন না তো আর কাকে বলবেন!
নাপাম গার্লের অবর্ণনীয় কষ্টের ছবি তিনি তুলেছিলেন আজ থেকে ৪৩ বছর আগে। এবার বুঝি অপার শান্তি আর স্বস্তির ছবিই তুলবেন। না ঠিক ক্যামেরার ফ্রেমে নয়, একটু অন্যভাবে। সম্প্রতি তার তত্ত্ববধানে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেছেন কিম। উদ্দেশ্য, দেশটির মিয়ামিতে একজন ডার্মাটোলজিস্টের কাছে বিশেষ লেজার ট্রিটমেন্ট নেওয়া।
কিম যেটিকে বলছেন, সেই ছবির মতো আমার নতুন যাত্রায়ও তাকে পাশে পেয়েছি। তার (নিক) মাধ্যমেই শুরু, তার মাধ্যমেই শেষ।
নিক অবশ্য ব্যাপারটি ছেড়ে দিয়েছেন মিয়ামি ডার্মাটোলজি অ্যান্ড লেজার ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক জিল ওয়াইবেলের হাতে। তার তত্ত্বাবধানেই বর্তমানে কিমের চিকিৎসা চলছে।
ওয়াইবেল জানান, নাপাম বোমায় পুড়ে যায় কিমের শরীরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এ ধরনের কেসে সাধারণত শরীরের প্রায় ১০ ভাগেরও বেশি মরে যায়। আর নাপাম বোমা অনেকটা জেলের মতো শরীরে লেপ্টে থাকে। এজন্য কিমের মতো ভিক্টিমরা কোনোভাবেই পুড়ে যাওয়া এড়াতে পারেন না।
‘দীর্ঘদিনের এই পোড়া ক্ষতের ফলে কিমের চামড়ার কোলাজেন লেয়ার নষ্ট হয়ে গেছে। এতদিন তীব্র ব্যথার মধ্য দিয়ে তাকে নড়াচড়া করতে হয়েছে। ডানহাতের মতো কিমের বামহাত খুব একটা প্রসারিত হয় না। ’
কিমের মুখে শুনলে, আর দশটি শিশুর মতো আমিও বানরের মতো গাছে চড়তে ভালোবাসতাম। ইচ্ছে খুশি পাকা পেয়ারা পেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খেতাম। কিন্তু পুড়ে যাওয়ার পর আর কখনও গাছে চড়তে পারিনি। আগের মতো বন্ধুদের সঙ্গেও আর খেলা হয়নি।
খেলতে হয়তো পারবেন না, তবে ওয়াইবেল আশা করছেন, কিমের সর্বোচ্চ সাত ধাপে চিকিৎসা প্রয়োজন। এজন্য আট থেকে নয় মাস সময় লাগতে পারে। আপাতত লেজার ট্রিটমেন্ট দিয়ে শুরু হয়েছে।
এরপর ঠিক হয়ে যাবেন কিম?
‘পুরোপুরি তো নয়। এ রকম দীর্ঘদিনের পোড়া ক্ষত সারিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে ভালোর দিকে যাবে, এটুকু আশা তো করাই যায়। ’
এ নিয়ে আশাবাদী কিমও। জানান, চিকিৎসা চালিয়ে যেতে ভীষণ অগ্রহী তিনি। তাতে যদি বছরও লাগে অপেক্ষা করবেন।
জোর দিয়ে এটিও বলতে ভুললেন না, ঈশ্বর আমায় ভালোবাসেন, এটিই একমাত্র মিরাকল ও আমার পাথেও। আমার কেবল একটিই ইচ্ছা, একদিন আমি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো!
বাংলাদেশ সময়: ০১২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৫
এসএস