মুক্তোর দানার মতো জলকণাগুলো যেন কোনও স্বর্গসুন্দরীর ঝকঝকে দাঁত, শ্বেতশুভ্র সে মুক্তোদানার ঝংকার তোলা হাসি শ্রোতাকে বিমোহিত করে, তার ছন্দময় ভঙ্গিতে অবিরল হেসে ওঠার উচ্ছ্বাসভরা দৃশ্য দর্শককে করে মন্ত্রমুগ্ধ। অপার্থিব এ শব্দ আর দৃশ্য আবহমান কাল ধরে কাছে টেনেছে ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ আর কবি-অকবি সবাইকেই।
এমনি এক নয়া সৌন্দর্যের টুকরোর সন্ধান পাওয়া গেছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কুরমাবিট এলাকায়। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশি ভূমিতে নয়া আবিষ্কৃত এ ঝরনার নাম হামহাম। স্থানীয়রা অবশ্য একে আদর করে বলছেন- হামহাম জলপ্রপাত।
‘হামহাম জলপ্রপাতের’ খোঁজে বেরিয়ে পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে বেশ দূরে থাকতেই পাহাড়ের দেড়শ ফুট ওপর থেকে জল আছড়ে পড়ার শব্দ পাওয়া গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃক্ষরাজির খোঁপের ভিতরে থেকে দেখা গেল সুন্দরীতমার অনিন্দ্য দেহসৌষ্ঠব।
কাছে গিয়ে এর সাঁ সাঁ শব্দ আর ঠাণ্ডা হাওয়ার আবেশে শরীর-মন দুটোই জুড়িয়ে গেল। অন্যরকম এক অনুভূতির আবেশ ভুলিয়ে দিল এতক্ষণকার দুর্গম পথ পেরুনোর সব কষ্ট-ক্লেশ।
এ জেলায় আরও রয়েছে কুলাউড়ার বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত মাধবকুণ্ড এবং শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের ভেতরের জাগছড়া জলপ্রপাত বা ঝরনা। জানা মতে দেশের কোথাও একই জেলায় তিনটি জলপ্রপাতের (বড় ধরনের ঝরনা) অস্তিত্ব নেই।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকার এ জলপ্রপাতটি এতদিন বনবাসী ও চা বাগান শ্রমিকদের দৃষ্টির ভেতরে লুকানো ছিলো। বাইরের মানুষের তা একপ্রকার অজানাই ছিল। সম্প্রতি কমলগঞ্জের সাংবাদিকরা জলপ্রপাতটি নিয়ে লেখালেখি শুরু করায় তা পর্যটক ও সরকারের দৃষ্টিতে আসে।
এরপর ক্রমশ বাড়তে থাকে পর্যটকের ভিড়। তবে হামহামে পৌঁছানোর জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বর্তমানে চাম্পারায় চা বাগানের কলাবল শ্রমিক বস্তি এলাকা পর্যন্ত ছোট ছোট যানবাহন ও মোটরসাইকেলে যাওয়া যায়। এরপর সেখান থেকে দীর্ঘ সাত কিলোমিটার বন্ধুর পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় ‘ঝরনা সুন্দরী’র আঙ্গিনায়।
যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে হামহাম পর্যটক আকর্ষণে মাধবকুণ্ডকেও হার মানাবে- এমন দাবি স্থানীয়দের।
এদিকে, এ মাসের শুরুতেই হামহাম জলপ্রপাতে বেড়াতে আসেন এভারেস্ট বিজয়ী দ্বিতীয় বাংলাদেশি মোহিত। এছাড়া এবারকার ঈদে হামহাম ছিল পর্যটকদের উপস্থিতিতে জমজমাট।
তরুণ পর্যটক কমলগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র জহিরুল ইসলাম মধু, কমলগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র নজরুল ইসলাম, সুমন মিয়া, রাসেল মিয়া, মামুন মিয়া বাংলানিউজকে জানান, চাম্পারায় চা বাগানের কলাবন থেকে পায়ে হেঁটে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর হামহামে গিয়ে উপস্থিত হই। সেখানে জলপ্রপাতটি দেখে পথের সব ক্লান্তি ভুলে যাই। পথিমধ্যে নজরে পড়ে আরও ছোট ছোট কয়েকটি ঝরনা। মূল হামহামের উল্টোদিকে আরও একটি আকর্ষণীয় জলপ্রপাত রয়েছে বলে দাবি করেন তারা।
পর্যটক দলের নেতা জহিরুল ইসলাম মধু আরও জানান, সেখানে পাথরের তৈরি একটি রাস্তা আছে। ধারণা করা হচ্ছে ওই রাস্তা কোনও গুহার নিদর্শন।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, এ জলপ্রপাতের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যে সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের নির্বিঘ্নে যাতায়াত, কিছু কিছু এলাকায় সাঁকো নির্মাণসহ অবকাঠামো সংষ্কার কাজও শুরু হয়েছে।
তিনি আরও জানান, হামহাম জলপ্রপাত এলাকায় মাধবকুণ্ডের চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদ্যমান এবং মূল জলপ্রপাতটি প্রস্থে মাধবকুণ্ডের চেয়েও বড়।
বাংলাদেশ সময় : ১৪২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১১