যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার এক দশক হয়ে গেল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনার এত বেশি ছবি তোলা ও বিতরণ করা হয়েছে যে মানব ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।
আক্রান্ত টুইনটাওয়ার শুধু বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র হওয়ার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি আমেরিকার অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের হৃৎপিণ্ড।
ওই সময় বিভিন্ন জনের ক্যামেরার ফ্রেমে এমন কিছু ব্যক্তি আবদ্ধ হয়েছেন যে মুখগুলি দেখলে এখনো মানুষের অনুভূতি নিঃসাড় হয়ে যায়। এই ছবিগুলো সেই ভয়াবহ ঘটনারই যেনো প্রতিনিধিত্ব করছে। এগুলো মার্কিনিদের সবচেয়ে শোকাবহ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে।
৯/১১ হামলার এক দশকপূর্তি উপলক্ষে সেই দিনের ৫ প্রতীক, যারা ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছেন, তাদের স্মৃতিচারণ প্রকাশ করা হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
জেনেলে গুজম্যান ম্যাকমিলান : ৪০ বছর বয়সী এই নারী সেই সময় টুইন টাওয়ারের উত্তর দালানে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া সর্বশেষ ব্যক্তি তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পরপরই তার ছবি তোলা হয়।
পরে তার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন। এখন গির্জায় গির্জায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান।
তিনি বলেন, ‘সেদিন ছিল অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক ও আনন্দঘন একটি সকাল। তখন আমার বয়স ৩০ বছর। আমি কাজে যাই এবং অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে হাসি-তামাশা করছিলাম। এমন সময় সবকিছু যেন নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল। সহকর্মীরা দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করছিল কিন্তু ধোঁয়া ঠেকানো যাচ্ছিল না। তখন আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকলাম।
এরপরই পুরো দালানটিই ভেঙে পড়ে গেল। আর এটা ঘটল খুব দ্রুত। আমি একেবারে নিচে পড়ে গেলাম। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ায় আমি নড়তে-চড়তে পারছিলাম না।
কংক্রিটের দুটি বড় চাঁইয়ের মাঝখানে আমার মাথা আটকে গিয়েছিল। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল। আঙুলে কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। আমি তখন আমার প্রিয়জন, আমার মেয়ে, বন্ধু ও সমস্ত জীবন সম্পর্কে ভাবতে থাকি। সেই সঙ্গে বাঁচার দ্বিতীয়বার একটা সুযোগের জন্য প্রার্থনা করতে থাকি।
একসময় হৃৎপিণ্ডের এক স্থানে কিছুতা উষ্ণতা ও পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো। ঠিক ওই সময় মৃদু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম তবে তা ক্রমেই আরও অস্পষ্ট হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘আমার বাম হাতটি ইট-সুরকির বাইরে নিতেই খোলা বাতাসের স্পর্শ অনুভব করলাম। হঠাৎ করে কে যেন আমার হাতটি ধরে ফেলল। সে বলল, ‘জেনেলে, তোমাকে পেয়েছি। আমার নাম পল। ’ কিন্তু তাকে আমি নাম বলেছিলাম কি না তা এখন মনে নেই। আমি শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, ‘আমরা আরেকজন জীবিতকে পেয়েছি। ’
প্রায় ২৭ ঘণ্টা আমি কংক্রিটের নিচে আটকা পড়েছিলাম। তবে উদ্ধারের পর পল একটি বারের জন্যও আমার সামনে আসেনি। আমি এখনো তাকে খুঁজছি।
বব বেকউইথ : দমকল বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মী সেদিন গ্রাউন্ড জিরোতে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন। ১৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে বিশাল এক ইট-সুরকির স্তূপের ওপর দাঁড়ানো অবস্থায় তিনি ক্যামেরায় ধরা পড়েন। বর্তমানে তার বয়স ৭৮ বছর। তিনি নিউ ইয়র্কেরই বাসিন্দা।
তিনি বলেন, ‘সেদিন সকালে আমার নাতি বাইসাইকেলে করে যাওয়ার সময় একটি গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়। তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। লোকজন তখন টিভি দেখছিল। আমিও দেখলাম দ্বিতীয় টাওয়ারটি ভেঙ্গে পড়ে গেল। প্রথমে আমার মনে হলো হয়তো স্বপ্ন দেখছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যেতে চাইলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আপত্তি করল।
তখন আমার বয়স ৬৯ বছর। আমি অবসরে। সবাই বলল, ওখানে শক্ত-সামর্থ্য লোকেরা যাক। কিন্তু যখন শুনলাম আমার এক বন্ধুর ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন আমি কারো কথা শুনলাম না।
পরের দিন সকালে আমার পুরনো ইউনিফরম গায়ে জড়িয়ে সেখানে গেলাম। কয়েক দিন ধরে সেখানে আমি উদ্ধারকাজে লেগে থাকি। কয়েকজন মানুষের বিচ্ছিন্ন অংশ খুঁজছিলাম আর ব্যাগে পুরছিলাম। ওহ! সেই দৃশ্য ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ।
১৪ তারিখে প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি আমি ভুলতে পারি না। আমি প্রথমে তাকে গোপন বাহিনীর লোক বলে ভুল করেছিলাম। আমাকে সেদিন টেলিভিশনে দেখা গিয়েছিল, শিশু থেকে বড়রা পরিচিত সবাই আমাকে সে কথা বলছিল। আমি খুব পুলকিত হয়েছিলাম।
এরপর মিডিয়ার লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার কাছ থেকে বিস্তারিত জানার জন্য। পরে আমার সাক্ষাৎকারসহ আমার ছবি টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছাপা হয়।
এর পর হোয়াইট হাউস থেকে প্রেসিডেন্টের ধন্যবাদপত্র ও মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ পেয়েছি আমি।
আমি সেই সব দিনের কথা কখনো ভুলব না। কিন্তু আজও বন্ধুর সেই বাচ্চাটির জন্য আমি প্রার্থনা করি, যাকে দমকল বাহিনীর ৩৪৩ জন কর্মী আর ২২৭ জন সেনাসদস্যও খুঁজে পায়নি।
মার্সি বোর্ডারস: মাত্র চার সপ্তাহ হয়েছে তিনি ব্যাংক অব আমেরিকায় চাকরি পেয়েছেন। ব্যাংকটি ছিল উত্তর টাওয়ারের ৮২ তলায়। ছবি প্রকাশের পর এই নারী ‘ধূলিময় নারী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ধুলোবালির নিচে আটকা পড়েছিলেন তিনি। ৩৮ বছর বয়সী এই নারী এখন মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য লড়ছেন। বসবাস করেন নিউ জার্সিতে।
তিনি বলেন, ‘আমি ফটোকপি মেশিনে কাজ করছিলাম। এমন সময় ‘বুম!’ করে আওয়াজ হলো। গোটা বিল্ডিংটা দুলে উঠল। হাঁটুর ওপর বসে পড়লাম। মনে হলো যেনো নিচের অংশ ভেঙ্গে পড়ছে। ওপরের দিকে তাকাতেই আকাশ দেখতে পেলাম। তখন খুব ভয় পেয়ে যাই।
নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে গেছি এমন সময়ই দেখলাম দেয়ালে ফাটল। সিঁড়ি বেড়ে যতো নিচে যাচ্ছিলাম ফাটলটি ততো গভীর হচ্ছিল। কিন্তু সিঁড়ির পথে লোকজন তখনও নাশতা করছিল। তারা বুঝতে পারেনি কী ঘটে যাচ্ছে।
লবিতে পৌঁছে দেখলাম লাখ লাখ মানুষ। অনেকের শরীরে ধাতুর টুকরা ঢুকে গেছে, কাচ লেগে চামড়া ছিঁড়ে গেছে। এর মাত্র দুই মিনিট পরেই পেছনের দক্ষিণ ভবনটি ভেঙে পড়ে।
পালাও পালাও বলে লোকজনের চেঁচামেচি শুনে আমিও লাফিয়ে পড়ে দৌড়াতে লাগলাম।
চোখের সামনে দেখলাম বিশাল ধুলির মেঘ পাক খেতে খেতে আমার দিকে ধেয়ে আসছে। একসময় হলুদ ধূলিমেঘের মধ্যে ঢাকা পড়ে গেলাম। সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলাম। এ সময় এক লোক আমার হাত ধরে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। অনেক কষ্ট করে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমার ধারণা এই সময়ই ছবিটি তোলা হয়েছে। তবে আমি তখন কিছুই টের পাইনি।
ওই ছবি আমি আগে কখনো আমার বাড়িতে আনিনি যদিও এখন আছে। আমার সুস্থতা কামনা করে গত কয়েক বছরে ৫ হাজার চিঠি পেয়েছি। ঠিকানায় আমার নাম লেখা ‘ধূলি নারী’ (ডাস্ট লেডি)।
অ্যান্ড্রু কার্ড : প্রেসিডেন্ট বুশের চিফ অব স্টাফ ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিমান হামলার খবরটি দিতে তিনি প্রেসিডেন্টের কানে কানে কথা বলছিলেন এ সময়ই তাকে ক্যামেরাবিন্দ করা হয়। ওই সময় বুশ ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সারাসোটায় একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্টকে একটি খবর দিতেই সেদিন সেখানে গিয়েছিলাম। আমি আশা করিনি এর জন্য আমি ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকব। আশা করি ওই ছবি মূল ঘটনার কোনো বিকৃতি ঘটাবে না। ’
তিনি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘এটি একটি আইকনতুল্য ছবি। তবে বিশ্বাস করুন আমি আইকনতুল্য কোনো ব্যক্তি নই। আমি ছিলাম অদৃশ্য চিফ অব স্টাফ। আমাদের কাজ ওভাল অফিসের ভেতরেই আর এ কারণে ক্যামেরার সামনে আসার সুযোগ নেই। কিন্তু ওই ঘটনা আমার জীবন ও কর্মের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ’
২০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার হঠাৎ থামিয়ে আমাকে বলেছিলেন, অ্যানডি, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগল। কিন্তু তুমি এখন একজন চিহ্নিত মানুষ। সন্ত্রাসীরা তাদের টার্গেট প্র্যাকটিস হিসেবে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তোমার সেই ছবিটি ব্যবহার করে। ’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়তো সেদিন মজা করে এ কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে তা সত্যিই আমার জন্য হুমকি হয়ে যায়। অনেক জায়গাতে আমাকে নানা রকম অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো।
কিন্তু ৯/১১-এ আমি শুধু প্রেসিডেন্টকে এরকম একটি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সহায়তা করার চেষ্টা করেছিলাম।
এড ফাইন : তিনি একজন বিনিয়োগ পরামর্শক। সেদিন উত্তর টাওয়ারে একটি মিটিংয়ে ছিলেন। ধুলোবালিতে ঢাকা অবস্থায় একটি ব্রিফকেস হাতে উদ্ধার হওয়ার পর ক্যামেরায় ধরা পড়েন তিনি। এরপর তাকে ‘ব্রিফকেস মানব’ বলে ডাকা হয়। পরে তিনি ফোর্বস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ হন।
তিনি বলেন, ‘যখন ছবিটি দেখি তখনকার প্রথম প্রতিক্রিয়াটি আজও আমার মনে ভাস্বর। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বেঁচে আছি। ৯/১১-এর পর আমি বুঝতে পারি আমার জীবন একটি সুতোর ওপর ঝুলছে। যে কোনো মুহূর্তে আমি মারা যেতে পারতাম। ’
পুরো ভবনটি যখন ভেঙে পড়ছিল তখন আমি সারা গায়ে ধুলোবালি মাখা অবস্থায় বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। যখনই আমি ওই ছবিটি দেখি তখনই আমার চোখের সামনে সেদিনের সব স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে। কিন্তু টুইন টাওয়ারের কথা ভাবলে এখনো আমি স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। হাডসন নদীর তীরে কী অভিজাতই না ছিল ওই টাওয়ার দুটি!
আমার ওই ছবিটি যে একটি আইকনতুল্য ছবি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসমসাহসী এক আমেরিকান ব্যবসায়ী, পরাভূত, ছাইয়ের স্তূপ থেকে বের হয়ে আসছে এবং ব্রিফকেস হাতে দৃঢ়তার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে হেঁটে যাচ্ছে। তুমি আমাদের ভেঙে ফেলতে পারবে কিন্তু দমিয়ে রাখতে পারবে না।
বাংলাদেশ সময় : ২১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১১