ঢাকা, রবিবার, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০১ জুন ২০২৫, ০৪ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন’

ধর্মনিরপেক্ষতার দলিল নয়

মাওলানা হোসেন আলী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫৯, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১১
ধর্মনিরপেক্ষতার দলিল নয়

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ কর্তব্য হিসেবে সামনে এসেছে। এজন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ধর্মনিরপেক্ষতা যে ইসলাম ধর্মের মূলনীতির বিরোধী নয় এবং রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যক্তিজীবনে মুসলমানিত্বের জন্য অন্তরায় নয়, এটা জনগণের জন্য বোধগম্য করা খুবই প্রয়োজন।

এ লক্ষ্যে ইদানীং অনেকে জেনে বা না জেনে কোরআন মজিদের আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে কে বা কারা ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন’ (তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আমার জন্য আমার ধর্ম) এই আয়াতটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার দলিল হিসেবে প্রথম প্রচার করতে শুরু করেছেন। কথাটি ভুল। ‘তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম’ কোরআনের সূরা কাফেরুনে বর্ণিত এ উক্তিটি ধর্মনিরপেক্ষতা বা সহিষ্ণুতার দলিল তো নয়ই, বরং প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি ছিল এর উল্টো।

বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর আগে পত্রিকান্তরে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম এবং আমার ‘মুসলমানের স্বাধীনতা’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পাঠকমহল থেকে এ বিষয়ে কোনো ভিন্নমত বা প্রতিক্রিয়া আমার কাছে আসেনি। আমি এ কথাটি বলতে খুবই বিব্রত বোধ করছি যে, আমাদের সরকারপ্রধানরাও দেশের মুসলিম সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষতায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে এ ভুল দলিলটি মাঝেমধ্যেই ব্যবহার করেন। তারা আরবি ভাষা বা কোরআন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাদের চারপাশে যারা থাকেন এবং যারা তাকে এ ভুল কথাটি শিখিয়েছেন তারা খুবই গর্হিত কাজ করেছেন।

কোরআন মজিদে বর্ণিত একটি বিচারের মূল তাৎপর্য না বুঝে একটি বাক্যাংশের বিচ্ছিন্ন অর্থ করে কিছু প্রমাণ করার চেষ্টা করলে সেটা হাস্যকর হবে এবং মূল বিষয়টাকে আরো দুর্বলই করবে।

‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন’ বাক্যটি কোরআন মজিদের যে সুরায় আছে সে সুরাটির নাম আল-কাফেরুন। ছোট্ট একটি সুরা, এখানে একটিমাত্র বিষয়ই আলোচনা করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে একটি সম্বোধনের মাধ্যমে আর সম্বোধনটি হলো, ইয়া আইয়্যুহাল কাফেরুন অর্থাৎ হে কাফেরগণ। কাফের কোনো জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা ধর্মের নাম নয়। কাফের হচ্ছে যুদ্ধের প্রতিপক্ষ, দুশমন, অবাধ্য বা দুষ্কৃতকারীরা। এখানে ইসলাম ও ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) সমূলে বিনাশ করে ফেলার জন্য উদ্যত হয়ে ওঠা মুশরেক কোরাইশদেরই এ সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, হে নবী আপনি বলে দিন, হে কাফেররা, তোমরা যাদের ইবাদত করো আমি তাদের ইবাদত করি না।
আর আমি যার ইবাদত করি তোমরা তার ইবাদত করো না। আমি কখনই তাদের ইবাদত করব না যাদের ইবাদত তোমরা করো আর তোমরাও তার ইবাদত করবে না যার ইবাদত আমি করি। অতএব তোমাদের জন্য তোমাদের পথ এবং আমার জন্য আমার পথ। আসলে ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন’ বাক্যটির মাধ্যমে কাফেরদের সঙ্গে চূড়ান্ত অসহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখানে কাফেরদের বলা হয়েছে যে, তোমাদের এথিক্স ও মূল্যবোধ এবং আমার এথিক্স ও মূল্যবোধ ভিন্ন হয়ে গেছে। তোমরা সত্যকে সত্য বলবে না, ন্যায়কে ন্যায় বলবে না। অথচ আমাকে সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করতে হবে। আসলে এই বাক্যটি প্রচ্ছন্নভাবে যুদ্ধের ঘোষণা, আপস না করার বার্তা।

আরো পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য সুরাটির শানে-নজুলের দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। এই সুরাটি নাজিল হয়েছে ইসলামের পথ অস্বীকারকারী মুশরেক কোরাইশদের একটি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে। হজরত মুহাম্মদকে (সা.) ইসলাম প্রচারের পথ থেকে বিরত করার জন্য তার স্বগোত্র অর্থাৎ কোরাইশ বংশের নেতারা সব রকমের চেষ্টাই করেছে। তাকে ভয় দেখিয়ে অত্যাচার করে বিরত করতে না পেরে নানারকম লোভ-লালসা দেখানোর চেষ্টা করেছে। তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেও বিষয়টি হজম করা খুব সহজ হবে না ভেবে সাময়িকভাবে পিছিয়ে গেছে। এরপর তারা একটা আপস প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। প্রস্তাবটা হলো, মুসলিম এবং মুশরিকরা মিলে বছরের ছয় মাস সবাই ইসলাম মেনে চলবে এবং পরবর্তী ছয় মাস সবাই কোরাইশদের আদি ধর্ম মেনে চলবে। তারা এটাকে এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতা বলে অভিহিত করতে চাইল এবং মক্কার সমাজে এ ধরনের সহিষ্ণু চর্চার প্রস্তাব নিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে হাজির হলো। এই প্রস্তাবের জবাবেই আল-কাফেরুন সুরাটি নাজিল হয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও পরমতসহিষ্ণুতা আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য এবং গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। এটা আধুনিককালের বিষয়, মানবসমাজের বিকাশ ও অগ্রগতিসংশ্লিষ্ট বিষয়। এর সঙ্গে ধর্মের আবির্ভাবের যুগের সরাসরি উদাহরণ টানার সুযোগ খুব কম এবং এর সঙ্গে বর্তমান যুগে বিদ্যমান ধর্মের একেবারেই কোনো সম্পর্ক নেই। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে ধর্মের এই যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই এটাই ধর্মনিরপেক্ষতা। ইসলামের ইতিহাসে নজির আছে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় যে রাষ্ট্রটি গঠন করেছিলেন সেই রাষ্ট্রটি ছিল মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মূর্তিপূজারী গোত্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মদিনা সনদকে বলা হয় আধুনিক রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধানের নজির। প্রকৃত অর্থেই মদিনা সনদ আধুনিক রাষ্ট্রের একটি সংবিধান। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন রাষ্ট্র এবং ধর্মের সম্পর্ক বুঝতে হলে সংবিধান কী তা আগে বোঝা দরকার। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের আগ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে মদিনা সনদ একটি চুক্তি বলেই অভিহিত হয়ে আসছিল। আসলেই এটি একটি চুক্তি। সংবিধান দ্ব্যর্থহীনভাবেই চুক্তিনামা।

অনেকে কোরআন মজিদকে মুসলমানদের সংবিধান বলে থাকেন। এটা আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক ধারণা না থাকাজনিত বিভ্রান্তি। কোরআন মজিদ কোনো চুক্তিনামা নয়, কোরআন মজিদ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত উপদেশের গ্রন্থ। মুসলমানদের জীবনে, সমাজে ও রাজনীতিতে এর উপদেশ ও পথনির্দেশের প্রভাব অবশ্যই থাকবে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধান বা চুক্তিনামা তৈরি হবে ধর্মের গ-ী অতিক্রম করে মানুষের স্বাধীন কল্যাণচিন্তার ওপর ভিত্তি করে। এটাই ধর্মনিরপেক্ষতা।

রাসুল (সা.)-এর নেতৃত্বে মদিনায় যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি দীর্ঘকাল ধর্মনিরপেক্ষ থাকেনি। প্রথমে ইহুদিরা মক্কার কোরাইশদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা করে চুক্তি ভঙ্গ করে। পরে অন্যান্য সম্প্রদায়গুলোও চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। কোরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের চূড়ান্ত বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলের (সা.) জীবদ্দশাতেই আরব ভূমির প্রায় সব মানুষই দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন এবং মদিনা রাষ্ট্র একক মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যায়। রাসুলের (সা.) ওফাতের পর তার ঘনিষ্ঠ সাহাবাদের শাসনামল তথা খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলেই তৎকালীন সভ্যতার এক বড় অংশ মুসলিম দুনিয়ায় পরিণত হয়ে যায়। উল্লেখ করা প্রয়োজন আল্লাহর রাসুলের (সা.) জীবদ্দশায় এবং তার সত্যায়িত উত্তরাধিকারীদের আমলে ইসলামের আহ্বান ছিল সার্বিকভাবে সত্যের আহ্বান এবং এর বিরোধিতা ছিল মিথ্যার আশ্রয়। মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল স্বেচ্ছায় ইসলামের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। মানুষ কোনো শাসকগোষ্ঠীর ভয়ে, লোভে বা বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেনি। ইসলামের অভিযান কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর অভিযান ছিল না, মানুষকে পদানত করার অভিযান ছিল না, বরং সে অভিযান ছিল মানুষকে মুক্ত করার। ইসলামের সে বিজয় ছিল নৈতিক, আদর্শিত এবং একাধারে কায়িক। এভাবেই তৎকালীন মানবসভ্যতার এক বড় অংশ অল্প সময়ে প্রায় একক মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। তবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্ম হিসেবে, ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে নয়। এই যে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা, এটাই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ। ইসলামের মর্মবাণীর ভেতরে প্রবেশ করলে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও পরমতসহিষ্ণুতার অনেক শিক্ষাই খুঁজে পাব। তবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মের আপ্তবাক্যের দলিল দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলে সেটা আবার ইসলামি ধর্মনিরপেক্ষতা হয়ে উঠতে পারে। যেমন মৌলবাদীরা প্রচার করে থাকে যে ইসলামি শাসনই ধর্মনিরপেক্ষ, কারণ ইসলামে অন্য ধর্মের মানুষদের অধিকার সংরক্ষিত আছে।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

বাংলাদেশ সময় ১৭৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।