মুদ্রাব্যবস্থা ও এর বিবর্তনের ইতিহাস চিরকালই এক আকর্ষণীয় বিষয়। আদিকালে মানুষের সমাজ, জীবনযাপন ও অর্থনীতি রক্ষায় যে বিনিময়ব্যবস্থার উদ্ভব তা ধীরে ধীরে প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে কড়ি, মুদ্রা, কাগজি নোট হয়ে আজকের স্মার্ট কার্ড ছাড়িয়েও অন্যতর বৈচিত্র্য আর খুব সুলভ ব্যবস্থায় পরিণতি পেয়েছে।
কিন্তু আজকের এ অবস্থানে পৌঁছুতে মানুষের হাজার হাজার বছর লেগেছে। কেবল তাই নয়, আজকের যে উন্নত প্রযুক্তিগত মুদ্রাবিনিময় ব্যবস্থা, তার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়।
বাংলাদেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশের মুদ্রাব্যবস্থা ও এর বিবর্তন নিয়ে সহজপাঠ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ বই আমাদের খুব একটা চোখে পড়ে না। যদিও শিশু-কিশোরপাঠ্য খুব সহজ কিংবা গবেষণা-ধরনের জটিল বই রয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ক্ষেত্রেই সম্ভবত এ কথা প্রযোজ্য।
সে অভাব পূরণের জন্যই যেন মুদ্রা ও ডাকটিকিট সংগ্রাহক এবং শখের গবেষক সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান এবং আরো পাঁচ সহ-লেখক মিলে একটি সময়োচিত পদক্ষেপ নিলেন। ‘কড়ি টু ঢাকা : ইভল্যুশন অব কয়েনস অ্যান্ড কারেনসিস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা এই বইটি নিঃসন্দেহে আগ্রহী সাধারণ পাঠক, মুদ্রা গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কল্যাণকর উদ্যোগ। সহ-লেখকরা হচ্ছেন এম মুহিবুল্লাহ, মো. জহিরুল ইসলাম, সাঈদ বিন সালাম, অরূপ কুমার সাহা ও আবদুস সামাদ।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অধিকাংশ এ জাতীয় বই আসলে আরও অনেক পুরনো বইয়েরই পুনঃসংকলন, নতুন মোড়কে। সেখানে পুরনো তথ্যই নতুন ভাষায় পরিবেশন করা হয়। গবেষণা বা অনুসন্ধান বা নতুন তথ্য তাতে খুব বেশি মেলে না। কিন্তু এই বইয়ের লেখকরা ও পথ খুব বেশি মাড়াননি। বরং মুদ্রাবিষয়ে তাঁদের নেশা এবং অনুসন্ধিৎসা, এ বিষয়ে তাঁদেরকে অনেকটাই গবেষকে পরিণত করেছে, যার ছাপ এ বইয়ের বিভিন্ন পাতায় দেখা যাবে।
কী আছে বইটিতে? সংক্ষেপে বললে, আদিকাল থেকে একেবারে হাল আমল পর্যন্ত মুদ্রাব্যবস্থার বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ বেশ সহজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন লেখকরা। বইটিতে বিশেষভাবে আমাদের ভূগোলের প্রাচীন ও মধ্যযুগ, বিশেষত গুপ্ত যুগ; সুলতানি, মোগল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের মুদ্রাব্যবস্থার বর্ণনা আছে। আর আছে বাংলাদেশের গত চার দশকের মুদ্রা প্রকাশের বিস্তারিত ইতিহাস। বইটিতে আছে প্রাচীন বিচিত্র কড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা এবং ১৯৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সব ধরনের মুদ্রা ও নোটের সচিত্র ছবি এবং এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা । এছাড়া আছে কাগজি মুদ্রার নিরাপত্তাব্যবস্থার বিস্তারিত বিশ্লেষণ, মুদ্রা সংগ্রহের আকর্ষণীয় তথ্য, বাংলাদেশের মুদ্রা ও কাগজি নোটের ক্যাটালগসহ বাংলাদেশ ব্যাংক, গভর্নর ও অর্থসচিবদের বিস্তারিত তথ্য।
এই বইয়ের প্রধান লেখক সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান আমাদের জানাচ্ছেন, ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানি শাসন আমলের ২৩ বছরে ১১১টি ধাতব ও ২১ ধরনের কাগুজে মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গত চার দশকে ২০ ধরনের ধাতব মুদ্রা এবং ৪৩ ধরনের কাগুজে মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোসহ প্রাচীন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আড়াই শতাধিক ধাতব ও কাগুজে মুদ্রার রঙিন ছবি আছে বইয়ে।
তিনি আরো জানাচ্ছেন, বইটি তাঁর ২৩ বছরের গবেষণার ফসল।
১৩২ পৃষ্ঠার এই সুমুদ্রিত বইটি প্রকাশ করেছে ট্রিউন-মনিটর পাবলিকেশন। দাম ৪৭৫ টাকা।
বইটির অনেকগুলো ভালো দিকের মধ্যেও খানিকটা মন্দ দিক রয়েছে। বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ রয়েছে, যা সহজেই এড়ানো যেত। কারণ ইংরেজিতে এ ধরনের সংশোধনের অনেক প্রযুক্তিগত সুবিধা রয়েছে, যা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এখনো নেই।
আগ্রহী পাঠকের জন্য এই ধরনের একটি বই সংগ্রহ ও পাঠ নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। তবে আরো বিপুল পাঠককে এই বইটি আস্বাদন করার জন্য আমরা এর লেখক ও প্রকাশককে একটি বাংলা সংস্করণও প্রকাশের অনুরোধ করতেই পারি।
বাংলাদেশ সময় ২২৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১