আন্তর্জাতিক নৃত্য অঙ্গনে আকরাম খান এখন একটি পরিচিত নাম। বিগত বছরগুলোতে অ্যান্থনি গ্রমলে, হানিফ কোরেশি, আনিশ কাপুর, নিতিন সোয়ানি, জুলিয়েট বিনোশে এবং কাইলি মিনোগের সাথে কাজ করে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন।
ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক পরিম-লে আকরাম খানকে তার প্রজন্মের সবচে সফল ব্রিটিশ মূলধারার সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে ধরা হয়। লন্ডনে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আকরাম খান সাত বছর বয়স থেকে বিখ্যাত কত্থক নৃত্যশিল্পী প্রতাপ পাওয়ারের কাছে নাচ শিখেছেন।
ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা এই বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পী তার শেকড় ভুলে যাননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরের প্রাক্কালে সম্প্রতি শুরু করেছেন তার নতুন প্রজেক্ট ‘দেশ’। এই নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরেছেন। কত্থক নাচের সাথে ওয়েস্টার্ন কনটেম্পোরারি নাচের সংমিশ্রণে তিনি ‘দেশ’ নৃত্যনাট্যটি তৈরি করেছেন।
প্রবাসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের আত্মপরিচয়ের সংকট একটি জটিল বিষয়। এসব ছেলেমেয়েদের নিজের দেশকে আপন করে নিতে অনেক কষ্ট হয়। বিশেষ করে প্রবাসে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সংকট প্রচ-। আকরাম খান স্বীকার করেন, তিনি নিজেও এই সঙ্কটের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। আকরাম খানের কাছে বাংলাদেশ বলতে শুধু তার বাসার ভেতরটুকুই। ঘরের ভেতর তার বাবা মা বাংলাতেই কথা বলেন। বাংলাদেশি রান্না হয়। বাবা বসে বসে বাংলা টেলিভিশন চ্যালেনগুলোই দেখেন। কিন্তু যখনই আকরাম খান ঘরের দরজা খুলে বাইরে চলে আসেন তখন তিনি একজন ব্রিটিশ। তার চারপাশের পরিবেশ, কাজের পরিধি সবই ওয়েস্টার্ন অথবা ইউরোপিয়ান সমাজের। যখন ঘরে ফিরে আসেন তখন আবার সেই বাংলাদেশি। এই দ্বৈতসত্তা তাকে ক্রমাগত ক্লান্ত করে তুলতে থাকে।
বিশ্বের নামকরা সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের সাথে কাজ করতে করতে তার অনেকবার মনে হয়েছে নিজের পরিচালনায় নৃত্যনাট্যের আয়োজন করার। কিন্তু কখনই তা হয়ে ওঠেনি। বরাবরই সেটা দলীয় অথবা ডুয়েট নৃত্যে পরিণত হয়েছে।
একবার হংকং-এ এক অনুষ্ঠান করার সময় সেট ডিজাইনার টিম ইয়েপের সাথে এই বিষয়ে আলোচনায় টিম পরামর্শ দেয়, ‘কেন তুমি তোমার নিজের অরিজিন নিয়ে একক নৃত্যনাট্যের পরিকল্পনা করছো না?’ আকরাম খান অবাক হয়ে জানতে চান ‘কোন অরিজিন, লন্ডন?’ টিমের উত্তর, ‘না, বাংলাদেশ, তুমি না বাংলাদেশি? তাহলে বাংলাদেশ নিয়ে কেন ভাবছো না?’
আকরাম খান তখন অবাক হয়ে ভাবেন, আরে তাই তো, আমি তো কখনও বাংলাদেশ নিয়ে ভাবিনি!
টিম ইয়েপের কাছ থেকে নিজের দেশকে নিয়ে কাজ করার পরামর্শ পেয়ে আকরাম বাংলাদেশে চলে আসেন। ঘুরেফিরে দেখেন সারা বাংলাদেশ, পর্যবেক্ষণ করেন বাংলাদেশের মানুষের আচার-আচরণ আর নিজের শেকড়। বোঝার চেষ্টা করেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি।
ব্রিটেনে ফিরে সেসব উপাদান নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করেন তার স্বপ্নের নৃত্যনাট্য ‘দেশ’। যোগাযোগ করেন হংকংয়ের সেই পরামর্শদাতা অস্কারবিজয়ী বিশ্ববিখ্যাত ভিজুয়াল ডিজাইনার টিম ইয়েপের সাথে। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ক্রাউচিং টাইগার হিডেন ড্র্রাগন’-এর ভিজুয়াল ডিজাইন করেছেন এই টিম ইয়েপ। তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান ‘দেশ’-এর সেট ডিজাইন করতে। লাইট ডিজাইনার মিশেল হলস এবং অলিভিয়ার অ্যাওয়ার্ডজয়ী সঙ্গীত পরিচালক জোসেলিন পোক যুক্ত হন ‘দেশ’-এর সাথে। দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চলে ‘দেশ’-এর কাজ।
আর মাত্র কদিন পর, ১৫ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরের দ্য কার্ভ থিয়েটারে ‘দেশ’ নৃত্যনাট্যের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হবে। ৪ অক্টোবর লন্ডনের সাদলার’স ওয়েলসে হবে লন্ডন প্রিমিয়ার।
ব্রিটেনের মাটিতে বাংলাদেশি আকরাম খানের শেকড়ের সন্ধান ‘দেশ’ এক অর্থে বিদেশে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের নিজের দেশের প্রতি মমতা ও দায়িত্ববোধের পরিচায়ক। আকরাম খানের ‘দেশ’ বিশ্বের সাংস্কৃতিক পরিম-লে বাংলাদেশি সংস্কৃতির দূত হিসেবে কাজ করুক, এই প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১১
