ঢাকা, রবিবার, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০১ জুন ২০২৫, ০৪ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

একজন বাউলের গল্প

ফেরদৌস আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:১২, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১১
একজন বাউলের গল্প

তিনি লালন শাহ, হাছন রাজা, রাধারমন, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ, উকিল মুন্সী, শেখ বানু এদেরকে মনেপ্রাণে লালন করে গান বুনেছেন, গান গেয়েছেন। তাদের পথ ধরে বাংলার আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে দিয়েছেন।

তার এই গানগুলি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে সঙ্গীত পিপাসু মানুষের কাছে।

তিনি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। তাঁর রক্ত ও চিন্তাভাবনা জুড়ে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা এবং বাংলার মাটির গন্ধ ছিলো। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ‘৬৯ এর গন-অভ্যূত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন, ‘৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহন। একজন শিল্পী ছাড়া দেশপ্রেমিক হিসেবে আমাদের কাছে তাকে পরিচিত করে তুলেছে তাঁর ভূমিকা। এছাড়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে কাগমারী সম্মেলনে গানে গানে তিনি যোগ দিয়েছেন। তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন।

সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ভাটির অঞ্চল ও আউল-বাউল-কবি এবং শিল্পীদের জন্মস্থান দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে এক কৃষক পরিবারে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ সালে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ইব্রাহিম আলি, মা-নাইওরজান বিবি, স্ত্রীর নাম আফতাবুন্নেছা (সরলা), সন্তান-শাহ নূর জালাল, নাতি- শাহ নূর ঝলক। বাউল শাহ আব্দুল করিম মারা গেলেন ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে সিলেট নুরজাহান পলি ক্লিনিকে। প্রায় ‘৯৫ বছর বয়সে এই মহাগুরু ভাটির বাউল, চারণ কবি, দেশের বাউল, একুশে পদকপ্রাপ্ত, বঙ্গবন্ধুর প্রিয়জন সাধককে আমরা হারালাম। তাকে আমরা হৃদয়ে স্থান দিয়েছি ‘বাউলসম্্রাট’ হিসেবে।

তিনি রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), একুশে পদক (২০০১), লেবাক অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা (২০০৪), চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা (২০০৫), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা (২০০৮), খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮), এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯) ও হাতিল অ্যাওয়ার্ড (২০০৯) পেয়েছেন। দেশের মাঠেঘাটে নিজের রচিত গান গাওয়া ছাড়া তিন বার লন্ডনে গিয়েছেন। এরমধ্যে ১৯৬৪ সালে প্রথমবার, ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয়বার ও ২০০৭ সালের ২৮ জুন তৃতীয় ও জীবনের শেষবার লন্ডনে যান।

প্রায় দেড় হাজারের মতো গান রচনা করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৭টি। স্বরচিত গ্রন্থগুলো হলো: আফতাব সঙ্গীত (১৯৪৮), গন সঙ্গীত (১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮), কালনীর কূলে (২০০১) ও শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯) এবং তার মৃত্যুর পর কবি-গবেষক সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত তার স্মৃতি নিয়ে মূল্যায়নধর্মী ‘শাহ আব্দুল করিম স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শাহ আব্দুল করিম মূলত গনসঙ্গীত শিল্পী হলেও মালজুরা, বিচ্ছেদ, ধামাইল, জারি, সারি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ও বাউল গানসহ নানা রকমের গান রচনা করেছেন।

তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কালনী নদীর পাড়ে বেড়ে ওঠেছেন তিনি। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালনী নদীর সাথে সখ্যতা থাকার কারনেই তিনি বাউল হয়েছেন। তবে তিনি তা-ও বলেছেন, তার ছেলেবেলায় দু:সম্পর্কের এক দাদা সারিন্দা বাজিয়ে ‘ভাবিয়া দেখ মনে/ মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে। ’ এ গানটি তাঁকে খুব অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি নিজের জীবন থেকে উপাদান নিয়েই গান তৈরি করতেন এবং সেই স্বরচিত গানই তিনি বাংলার পথে-প্রান্তরে গেয়ে বেড়াতেন। গানের প্রতি তার ঝোঁক ছিল প্রচন্ড। একদিন তার পরিচয় হয় বাউল কামালউদ্দিনের সঙ্গে। তার কাছেই জীবনের প্রথম বাউল গানের দীক্ষা শুরু করেন। তারপর সাধক রশীদউদ্দিন, শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বক্সের কাছেও দীক্ষা নিয়েছেন তিনি। তারপর থেকে সুনামগঞ্জের হাওড় অঞ্চলের মানুষের কাছে তিনি বাউল হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেন।

তার স্বরচিত প্রায় দেড় হাজার গানের মধ্যে সংগ্রহে আছে মাত্র ৬শ’ গান। বন্ধে মায়া লাগাইছে, গাড়ি চলেনা চলেনা, আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, বসন্ত বাতাসে সইগো, কোন মেস্তরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়, আইলা না আইলা নারে বন্ধু, মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ হওয়া যায়, সখি কুঞ্জ সাজাওগো, আমি কূলহারা কলংকিনী, কেমনে ভূলিবো আমি বাঁচিনা তারে ছাড়া, রঙের দুনিয়া তোরে চাইনা ইত্যাদি গান দেশে বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শাহ আব্দুল করিমের ১০টি গান ইংরেজীতে অনুবাদ করেছে বাংলা একাডেমী।

শাহ আব্দুল করিমের বাবা ছিলেন একজন গরীব কৃষক। কৃষক পরিবারে অভাব অনটনের মাঝে বেড়ে ওঠলেও সংগীতের মায়া তিনি ত্যাগ করতে পারেন নি। লেখাপড়া করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার দ্বারা পরিচালিত নৈশ-বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দিনে রাখালের কাজ করে রাতে পড়াশুনা শিখতে নৈশ-বিদ্যালয়ে যেতেন। অক্ষরজ্ঞান শিখার পর তার মন লেখাপড়ায় বসেনা। তাকে বাউল হতে হবে তাই তিনি প্রকৃতিতে নিজেকে খুঁজে পান। তারপর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তিনি আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন। এসময় তিনি তার গুরুদের সাথে বর্ষা মওসুমে হাওড় অঞ্চলে গান গেয়ে বেড়াতেন। একদিন ওস্তাদের কথা রাখতে গিয়ে বিয়ে করেন আফতাবুন্নেছাকে। আব্দুল করিম তার স্ত্রীকে ভালোবেসে ডাকতেন ‘সরলা’ নামে। ১৯৯৭ সালে মারা যান সরলা।

জনশ্র“তি আছে, সরলার মুত্যুক্ষণে শাহ আব্দুল করিম পাশে থাকতে পারেননি, তিনি ছিলেন একটি অনুষ্ঠানে গানে মত্ত ছিলেন। পরে খবর পেয়ে বাড়িতে যান এবং ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাওগো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’ ‘কেমনে ভূলিবো আমি বাঁচিনা তারে ছাড়া’ এই গানগুলি রচনা করেন।

তার স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, সরলার কবর তিনি তার শোবার ঘরের সামনের উঠোনে দিয়েছেন এবং তার ইচ্ছানুযায়ী তার কবরও সরলার কবরের পাশে দেওয়া হয়েছে।

তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সরলা না থাকলে আমি বাউল শাহ আব্দুল করিম হতে পারতামনা। সরলা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমার বাউল জীবনের মুর্শিদজ্ঞান সরলা। বাউলসম্্রাট শাহ আব্দুল করিমের স্বপ্নের ‘বাউল করিম সঙ্গীত বিদ্যালয়’টি একটি টিনশেড ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এব্যাপারে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত বলে উজানধল গ্রামের মানুষ মনে করেন।

বাংলাদেশ সময় ২২০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।