আফ্রিকার দেশ মালাবিতে তামাক উৎপাদনের জন্য ভরা মৌসুমে মাঠে শিশুদের তামাকগাছের হলুদ পাতা সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
এই শিশুশ্রমিকদের মধ্যে মালাবির তামাক উৎপাদনকারী জেলা কাসুনগুতে পাঁচ বছর বয়সী ওলোফালা নামের এক শিশুশ্রমিকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
আগামী বছর থেকে সে স্কুলে যেতে ইচ্ছুক কি-না জানতে চাইলে সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তার এ ধরনের সম্মতিতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, জীবন বাঁচাতে আগে তাকে কাজ করতে হবে, পরে শিক্ষা গ্রহণ। তার ১২ বছর বয়সী বোন ইথেল তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তবে কাজ করা এবং অধিকাংশ সময় অসুস্থতার জন্য সে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না।
ইথেল কাশতে কাশতে জানায়, ‘আমার বুক ও মাথা ব্যাথার অসুখ রয়েছে। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। ’
এসব অভিযোগগুলো সাধারণ নয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, মালাবিতে ৮০ হাজার শিশু তামাক শ্রমিক বিভিন্ন রোগে ভুগছে, যাকে ‘সবুজ দুর্বলতা’ বা ‘নিকোটিন বিষক্রিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে রোগের লক্ষণ হিসেবে মাথা ব্যথা, তলপেট ব্যথা, পেশির দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, বমি হওয়া, উচ্চ রক্ত চাপ এবং হার্টের কম্পন বাড়াকে শনাক্ত করা হয়েছে।
কেন্টাকি ও নেক্সিনটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য কলেজের অধ্যাপক রবার্ট ম্যাকনাইট ২০০৫ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করার সময় এই শিশুশ্রমিকরা কোনো রকম আত্মরক্ষামূলক কাপড় ব্যবহার করে না। কাজের সময় প্রতিদিন তাদের শরীরের চামড়া দিয়ে ৫৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত নিকোটিন শরীরে প্রবেশ করে, যা ৫০টি সিগারেটে থাকা নিকোটিনের সমান।
কাসুনগু জেলার ফ্রাসটন নামের এক মালিক প্রতি বছরই ১৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করেন। তিনি তার জমিতে কর্মরত শিশুশ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনোদিন শুনিনি যে তামাক পাতায় হাত দিলে ক্ষতি হয়। ’
তামাকপানকারী, বিশেষ করে যারা ধূমপান করে, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ অবচেতন ধূমপায়ী মনে করে ধূমপানের মাধ্যমে শুধু তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। তারা জানে না যে তাদের এ খারাপ অভ্যাসের কারণে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা তামাক উৎপাদনের কাজে জড়িত।
২০১০ সালে আমেরিকার শ্রম বিভাগের এক তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের পর আমেরিকায় বিশ্বের অধিকাংশ বড় বড় তামাক শিল্পগুলো গড়ে ওঠে। কিন্তু আজ বিশ্বের ৮৫ শতাংশ তামাক উৎপাদন বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলে হয়ে থাকে। যেখানে শিশুশ্রমই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
ক্যালিফোর্নিয়ার তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্রের গবেষক মার্টি ওথানজ বলেছেন, বিশ্বের যেসব উন্নয়নশীল দেশে তামাক উৎপাদন করা হয় সেখানের শিশুশ্রমিকদের বয়স সাধারণত পাঁচ বছর থেকে শুরু হয়।
আফ্রিকার শিশুশ্রম আইন লঙ্ঘনকারী দেশগুলোর মধ্যে মালাবিতে সবচেয়ে বেশি শিশুশ্রমিক রয়েছে। সেখানে শিশুরা স্বাস্থ্যগত ছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হয়।
ওলোফালা এবং ইথেল তারা বাবা মায়ের সঙ্গে তামাক নিয়ে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও তারা কোনো মজুরি পায় না।
তারা পিতা-মাতাকে তাদের কাজে সাহায্য করে মাত্র। তাদের পিতা-মাতা কাসুনগুর ২২ হাজার তালিকাভুক্ত ফার্মের একটিতে কাজ করেন। তবে অন্য শিশুরা দীর্ঘ সময় বিরামহীন কঠোর পরিশ্রম করার পর ০.২৫ স্থানীয় মুদ্রা পেয়ে থাকে, যা দিয়ে একজনের এক বেলার খাবার কেনা সম্ভব নয়।
তবে পারিশ্রমিক যাই হোক না কেন যারা সেটা পায় তাদের সৌভাগ্যবান মনে করা হয়, কারণ অন্যরা কোনো পারিশ্রমিকই পায় না।
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার নামের একটি এনজিওর মালাবি প্রজেক্টের ম্যানেজার গ্রাস মাসানিয়া বলেন, ‘ভালো পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলে অনেকে শিশুকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। আমাদের কাছে এ ধরনের অনেক রিপোর্ট আছে কিন্তু তামাক চাষের মৌসুম শেষ হলে তাদের ভাগ্যে জোটে মাত্র একটি পুরাতন শীতবস্ত্র (সোয়েটার)। ’
বলা হয়ে থাকে, মালাবির দুর্বল অর্থনীতির কারণে সে দেশের বাবা-মায়েরা পরিবারে সবার জন্য খাবার জোগাড় করার জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদেরও কাজে লাগান।
গত দশক থেকে তামাক আমদানিতে শুল্ক কমানো, শস্তা শ্রম এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে মালাবি বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ তামাক উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করেছে।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী মালাবির ৯৮ শতাংশ শস্তা তামাক পাতা আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি করা হয়।
এছাড়া মালাবির রপ্তানি করা তামাক পাতার ৯০ শতাংশ আমেরিকাভিত্তিক দুই শীর্ষ কোম্পানি আন্তর্জাতিক তামাক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পুনরায় বিক্রি করে। তাদের প্রধান ক্রেতা বিশ্বে সিগারেট প্রস্তুতকারী দুই প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো ফিলিপ মরিস (মার্লবোরো) এবং ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো (লাকি স্ট্রাইক)।
পশ্চিমের প্রতিটি সিগারেট মালাবিতে উৎপাদিত তামাক দিয়ে তৈরি বিজ্ঞানীরা এমন প্রমাণও পেয়েছেন।
বাংলাদেশ সময় : ২১২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১১