ঢাকা, রবিবার, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০১ জুন ২০২৫, ০৪ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

আমি কৃষক মতিউর

সালেক খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৪০, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১১
আমি কৃষক মতিউর

ছেলেমেয়েদের জন্য অগাধ সম্পত্তি রেখে যাওয়ার পক্ষে নন কোবাদ আলী। পেশায় তিনি স্কুল শিক্ষক।

ভিন্ন চিন্তার কারণে পুরিয়া গ্রামের সবাই তাকে বিশেষ সম্মান করে। তার মতে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করলে সততা আর দায়িত্বশীল হবে। এভাবে প্রকৃত মানুষ হলে নিজেরাই দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে। ফলে জীবনের প্রয়োজনে সম্পত্তি করা তাদের জন্য কোনো কঠিন বিষয়ই হবে না। তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার-দেনা করে বহু কষ্টে চালিয়ে যাচ্ছেন পাঁচ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ। সন্তানদের কখনো বুঝতে দেননা আর্থিক দৈন্য দশার কথা। এভাবেই চলছিল সবকিছু।

বড় ছেলে মিজানুর রহমান যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে তখন ছোট ছেলে মতিউর রহমান ডিগ্রি নিচ্ছেন সেতাবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে। অন্যরা ভালোভাবে লেখাপড়া করলেও মতিউর ছিল বাবা কোবাদ আলীর বিশেষ চিন্তার কারণ। দিনাজপুর জেলা স্কুলে পড়ার সময় থেকে শিক্ষকদের মুরগি ও ছাগল জবাই করে খাওয়া, বিভিন্ন ব্যক্তিদের থেকে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করা আর মারামারিই ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ফলে হরহামেশাই ছেলের বিচার আসতো কোবাদ মাস্টারের কাছে। শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত হতেন, কষ্ট পেতেন নিজের সন্তানের কৃতকর্মের জন্য।

১৯৯৬ সাল। মতিউর তখন দিনাজপুর সরকারি কলেজে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করছেন। বাবা কোবাদ আলী মাস্টারের ধার জমে যায় পাহাড় সমান। জমিজমা অধিকাংশই বন্ধক পড়ে যায় মহাজনদের কাছে। দুষ্টু হলেও স্কুল মাস্টার বাবার জন্য মতিউরের মন কাঁদে।   একরাতে বাবার আর্থিক অবস্থার নানা কথা চিন্তা করে মতিউরের চোখ ভিজে যায়। সারারাত ঘুমাতে পারেনা। ভোর হওয়ার আগেই মতিউর সিদ্ধান্ত নেয় যেভাবেই হোক তাকে বদলাতে হবে, দাঁড়াতে হবে বাবার পাশে।

শিক্ষিত হওয়ায় মতিউর সহজেই বুঝে যায় নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করতে তাকে চাকরির ওপর নির্ভর করলে চলবে না। করতে হবে স্বাধীন ব্যবসা।   কিন্তু কি ব্যবসা করবে?

নিজের উন্নতির জন্য মতিউর তখন বেছে নেয় কৃষি কাজকে। নিজের শিক্ষা আর বাপ-দাদাদের জমিজমায় নতুন ধারায় চাষ করে উৎপাদন বাড়িয়ে লাভবান হওয়াই তার মূল লক্ষ্য। শিক্ষিত হয়ে মতিউর যখন জমি-বাড়ি (স্থানীয়রা মাঠের কাজকে জমি-বাড়ি বলে)-তে কাজ শুরু করে তখন গ্রামের লোকেরা তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে থাকে, ‘বাপের জমি ফুরাইতে আইসছে। ’ গ্রামের লোকদের কথা মতিউরকে বেশ কষ্ট দেয়। মাঝে মাঝে রাগও হতো। কিন্তু কোন প্রতিবাদ না করে মনে মনে শপথ নেয় যে করেই হোক তাকে কৃষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে।

এখন দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সকলেই একনামে তাকে চিনবে ‘কৃষক মতিউর’ হিসেবে।
 
পরিকল্পনা মোতাবেক জমি বন্ধক দিয়ে ৩০ হাজার টাকা আর স্থানীয়  একটি ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছোট একটি পাওয়ার টিলার কিনে ফেলে। পুরিয়া গ্রামে সে সময় পাওয়ার টিলার ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। গ্রামের লোক দেখতে থাকে মতিউরের কীর্তি।

দুষ্টু মতিউর পাওয়ার ট্রিলার দিয়ে সারারাত নিজের জমি চাষ করে আর দিনে অন্যের জমিতে সেটি ভাড়া দিয়ে প্রতিদিন আয় করে ১২০০ টাকা। পাওয়ার ট্রিলারের ভাড়ার টাকা দিয়ে শোধ করেন ব্যাংক ঋণের টাকা। সে সময় অফিসার হিসেবে তার চাকরি হয় অগ্রণী ব্যাংকে। কিন্তু সে চাকরিতে যোগ দেয় না মতিউর। সে তখন নিজেকে বদলিয়ে কৃষক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। সেই বছর নিজেদের জমিতে লাগানো আমনে তার সম্ভাবনাময় ফলন আসে। লাভ করেন অনেক টাকা। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি মতিউরকে।

ভালো ফলনে মতিউরের মনোবল বেড়ে যায়। দুষ্টু মতিউর তার ক্ষেতের আইল ধরে প্রথমে লাগায় ৬৪টি লিচু গাছ। আইলে লিচু গাছ লাগানোয় স্থানীয় কৃষকদের কাছে এটি মতিউরের পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। লিচু থেকে যখন ফলন আসতে থাকে তখন কৃষকদের ভুল ভাঙে। ক্রমেই কৃষকদের কাছে মতিউরেরও কদর বাড়তে থাকে। অন্য কৃষকরাও ধীরে ধীরে অনুকরণ করতে থাকে মতিউরকে। এভাবেই চকভবানী মৌজা ভরে যায় লিচু বাগানে। মতিউর জায়গা করে নেন কৃষকদের মনে।

ফসল বা ফল সংগ্রহের পর তিনি জমির আশপাশের লোকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিছু অংশ বিতরণ করেন। তার ভাষায় এটি ‘প্রতিবেশীর হক’। ফলে মতিউরের ফল বাগান বা ফসল কখনই চুরির ভয়ে পাহারা দিতে হয়নি। বরং প্রতিবেশীরাই তা ভালোবেসে রক্ষা করেছে। বিভিন্ন সময়ে ভুট্টা চাষ করে রেকর্ড পরিমাণ আয় করা, বিএডিসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বীজ উৎপাদন করা, নতুন জাতের রেকর্ড পরিমাণ আলুর উৎপাদন করে লাভবান হওয়াসহ বিভিন্নভাবে মতিউরের উপার্জন বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিজেদের যাবতীয় দেনা পরিশোধ করেও বর্তমানে মতিউর তৈরি করেছে ধানক্ষেতে মাছ এবং আপেল ও বাউকুলের ১২০০ গাছের নজরকাড়া প্রকল্প। জমির আইলের মধ্যে লাগিয়েছেন ৬০০টি লিচু গাছ। জমির জৈব সারের প্রয়োজনে গড়ে তুলেছেন ৫৭টি গরুর খামার। জমির পাশের বড় পুকুরের মাছের খাদ্যও আসে সেই খামার থেকে। এছাড়াও নিজেদের ফসলের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন ‘মিম হাসকিং মিল’।
 
সব খরচ বাদ দিয়ে বর্তমানে মতিউরের নিট আয় ১ লাখ টাকা। বছর দুয়েক পরে লিচু ও কুলের গাছ আরও বড় হলে মাসিক আয় দাঁড়াবে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা।

মতিউর এখন এ অঞ্চলের কৃষকদের উদাহরণ। বাবা কোবাদ আলী এখন লজ্জিত নয়; গর্বিত পিতা। একজন শিক্ষিত ছেলে কৃষিতে এসে পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিসহ নিজের আর্থিক উন্নতির নজির ‘কৃষক মতিউর’।
 
বিরল উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ এজামুল হক মতিউর সম্পর্কে বলছিলেন, ‘কৃষিতে যে অল্প সংখ্যক কৃষক নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে মতিউর তাদের মধ্যেও প্রথম। শিক্ষিত হওয়ায় খুব সহজেই সে নতুন নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা আয়ত্ত করতে পেরেছে। আর পরিশ্রম ও নিবিড় যতেœর মাধ্যমে উৎপাদনে সফল হয়েছে। তার কারণে অন্য কৃষকরাও প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত হচ্ছে। ’

তিনি আরও জানান, ‘ধানক্ষেতে মাছ ও কুল চাষ এবং রেকর্ড পরিমাণ উন্নত জাতের আলুচাষের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে কৃষি অধিদপ্তর থেকে দুটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে এ দুষ্টু মতিউর। ’

মতিউর বলেন, ‘একক কৃষি করে কৃষক বাঁচবে না’। জাতীয় পুরস্কার মতিউরকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তার মতে, ‘কৃষকদের সামাজিক সম্মান বা স্বীকৃতি  বৃদ্ধি করতে না পারলে শিক্ষিত ছেলেরা কৃষিতে আসবে না। একইসঙ্গে শিক্ষিতদের কৃষিতে আনতে পারলেই বেকার সমস্যার সমাধান হবে। পাশাপাশি বাড়বে উৎপাদন । আর তাহলেই বাস্তবায়িত হবে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশে গড়ার কার্যক্রম। ’ মতিউর আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমরা সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত অথচ আমাদের দেশে কোন সরকারি অনুষ্ঠানে সকল পেশা-শ্রেণীর লোকদের দাওয়াত করা হলেও কোনো কৃষককে দাওয়াত করা হয় না। কৃষকদের শস্য বীমার সুযোগ নেই, নেই কোনো অবসর ভাতার ব্যবস্থা। এগুলো করতে পারলে কৃষিতে উন্নয়ন ঘটবে। কমে যাবে বেকার সমস্যা’। তিনি প্রস্তাব করেন প্রকৃত কৃষক ছাড়া অন্যদের কাছে কৃষি জমি বিক্রি রহিত করার আইন তৈরির বিষয়ে।

পুরিয়া গ্রামের যুবক ও কৃষকদের নিয়ে মতিউর তৈরি করেছেন পুরিয়া মিলন সংঘ। গ্রামের বিভিন্ন রাস্তায় বৃক্ষরোপণ ছাড়াও এই ক্লাবের মাধ্যমে কৃষি অধিদপ্তরের নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করছেন কৃষকদের। কাজ করছেন এদেশের কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।

পিতার স্বপ্নের মতিউররা ভাইবোন সবাই আজ শিক্ষিত। সবাই দেশের সম্পদ। তাই জীবনের প্রয়োজনে সম্পত্তি এসেছে সহজ ভাবে। কোনো অহংবোধ নেই মতিউরের মনে। অকপটে স্বীকার করেন কৃষি অফিসের অবদানের কথা। কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়; সর্বজনীনভাবে স্থানীয় কৃষকদের অভিভাবক মতিউর। তবুও অহংকারের লেশ মাত্র নেই তার আচরণে। অপরিচিত কোনো লোক তার সফলতার গল্প শুনে তার সঙ্গে দেখা করতে আসলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হাত বাড়িয়ে মতিউর বলেন `আমি কৃষক মতিউর। ’

ছবি: সালেক খোকন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।