ঢাকা, সোমবার, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০২ জুন ২০২৫, ০৫ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

‘কৌতুক এবং ভাঁড়ামি এক নয়’

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪০, অক্টোবর ১০, ২০১১
‘কৌতুক এবং ভাঁড়ামি এক নয়’

কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর আসবে, মানুষ হাসানো!। মানুষ হাসিয়ে হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়াকে অনেকেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করেন।

জি বাংলার কমেডি শো মীরাক্কেলের মোশাররফ আলম খান ইয়াফিও তাই মনে করেন।

শুরুতে ইয়াফির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি ২০১০ সালে মীরাক্কেলে বাংলাদেশের প্রতিযোগী ছিলেন। মীরাক্কেলে প্রথমবারের মতো গত বছরই বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পান। সুযোগ পেয়েই কলকাতায় উড়ে চলে যান ইয়াফিসহ আরও বেশ কজন। ইয়াফি সেবার মীরাক্কেলে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন।

প্রশ্ন করি, শুরুটা কীভাবে করলেন? ইয়াফি হাসেন। হাসতে হাসতে বলেন, ‘আসলে সবাই মনে করে আমার হয়তো মীরাক্কেল দিয়েই শুরু। সত্যি কথা হলো, মীরাক্কেলের আগেই আমি টিভির সাথে যুক্ত ছিলাম। ২০০১ সালে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে ‘সময় বহিয়া যায়’ নামে একটি অংশের উপস্থাপনা করতাম। তবে মীরাক্কেল আমার জীবনে অন্যরকম মাত্রা যোগ করেছে। পরিচিতি তৈরি করেছে। যা আগে হয়নি। ’

ইয়াফির অফিসে বসে আমাদের আড্ডাটা এসব কথা দিয়েই জমে ওঠে। আমি প্রশ্ন করি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে। বাংলাদেশে স্ট্যান্ডআপ কমেডির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা কোথা থেকে পাওয়া? এ প্রশ্নে ইয়াফি কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়েন। বললেন, ‘আমি ’৯৬ সাল থেকেই থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলাম। স্কুলিংটা সেখানেই শুরু। নানা চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দেখলাম, শুধু স্ক্রিপ্টে লেখা ডায়ালগ দিয়েই দর্শকের মনে স্থান পাওয়া যায় না। দরকার নিজস্বতা। ভাবতাম, কীভাবে ভিন্নতা তৈরি করা যায়। তখন স্ক্রিপ্টের বাইরে নিজের থেকেই ডায়ালগ যোগ করে দর্শকদের মজা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেখানে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন ছিল। অনেক মাথা খাটাতে হতো। অন্যদিকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের হাসানোর কাজটা আমাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিত।

এরপর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন সেখানে ড্রামা ক্লাবের সাথে কাজ করতাম। আমি পড়াশোনা করেছি নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে আমাদের কালচারাল কাজ করার অনেক সুযোগ ছিল। সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতাম। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করার সময় দর্শকদের মজার মজার কৌতুক বলে হাসাতাম।

এ বিষয়টি নিয়ে একদিন আমার এক শিক্ষক বললেন, তুমি যে কাজটা করো সেটাকে আমেরিকাতে বলা হয় স্ট্যান্ডআপ কমেডি। সেখানে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বাংলাদেশের এর চলন নেই। সেই প্রথম স্ট্যান্ডআপ কমেডি সম্পর্কে আমার ধারণা হয়। ’  
 
উপস্থাপনা দিয়ে শুরু করে নিজের অজান্তেই ইয়াফি জড়িয়ে গেলেন  কৌতুকের সাথে। তাই আবার ফিরে আসি মীরাক্কেল প্রসঙ্গে।

ইয়াফি বললেন, ‘২০০৯ সালের ডিসেম্বরে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখলাম। এত মাথা ঘামাইনি। একদিন আমার এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলল, তুই তো ভালোই মজা করতে পারিস।   মীরাক্কেলে আবেদন করে ফেল।                                                  

আবেদন করে ডাক পেলাম। অডিশন রাউন্ডে খুব নার্ভাস ছিলাম। একটা কৌতুক বললাম। তখন মীরাক্কেলের এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার নবনীতা চক্রবর্তী বললেন, ‘তোমার কৌতুকে খুব চমৎকার সেন্স আছে কিন্তু হাসিটা কম’।

এরপর আমাকে কিছুক্ষণ সময় দেওয়া হলো। আমি আরো কিছু কৌতুক বলার পর তিনি খুশি হয়ে বললেন ‘ওয়েল ডান’। এরপর কলকাতা যাই। সেখানে গিয়ে তো আমি অবাক। ওরা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছে। কৌতুক নিয়ে রীতিমতো তারা গবেষণা করছে। সেখানে আমার গ্রুমিংটা ছিল অসাধারণ। ’

‘সেখানে চ্যালেঞ্জিং সময়টা কীভাবে সামাল দিয়েছেন?’ এ প্রশ্নে ইয়াফি বলেন, ‘সেখানে কৌতুক নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেলাম। অনেক কিছু শিখলাম। আমি মোট ১৭টি পর্বে অংশগ্রহণ করেছি। এর মধ্যে ১৫টি পর্বের স্ক্রিপ্টই আমার নিজের লেখা। আবেগও কাজ করছিল। বাংলাদেশ থেকে আমরা প্রথম তখন কলকাতায় গেছি। একদিন এক মহিলা এসে আমাকে বলেন, ঢাকা থেকে এসেছিস? আমি বললাম, জি বউদি। মহিলা তখন বললেন, ‘ঢাকা থেকে এসেছিস, হারলে চলবে না। ওটা আমার বাবার দেশ। ’ আমি স্পষ্ট দেখছিলাম, মহিলাটির চোখে তখন পানি টলমল করছে। ’  

আড্ডার এক পর্যায়ে চা খাওয়ার জন্য আমরা ক্যান্টিনের দিকে যাই। আলাপের সময়ও  শেষ হয়ে আসছে। তখন একটি প্রশ্ন ছুড়ি, এমন অনুষ্ঠান বাংলাদেশে কেন জনপ্রিয়তা পায় না? ইয়াফি প্রশ্নটি শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বলেন, ‘বাংলাদেশে মীরাক্কেল থেকে ফিরে আমি এনটিভিতে ‘হাসো’ নামে একটি অনুষ্ঠান করি। সে অনুষ্ঠানে অনেক ভালো ভালো প্রতিযোগী ছিল। কিন্তু আমাদের দেশে জোকসের অনেক বাধা আছে। সেগুলো নিয়ে কখনো মীরাক্কেলের মতো স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। ’

আমি আবার প্রশ্ন করি, বাধাগুলো কী কী? তিনি তখন এগিয়ে এসে বলেন, ‘লিখেন লিখেন। পয়েন্টগুলো লিখেন। আমি এগুলো বলতে চাই। প্রথমেই হচ্ছে, রাজনৈতিক কৌতুক এ দেশে বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, প্রাপ্তবয়স্ক কৌতুক বলা যায় না। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের সেলিব্রেটিদের নিয়ে কৌতুক বলা যায় না। এই তিনটি কারণ যদি উঠিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে দেখবেন আমাদের কমেডি শোগুলো কোথায় চলে গেছে। এছাড়া কৌতুকের দর্শক হওয়ার জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা। ’

ইয়াফি একাধারে উপস্থাপক, কৌতুককার। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতে পছন্দ করেন। তবে সম্পূর্ণ প্রফেশনালভাবে। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের দেশে কৌতুক হয়। তবে সেখানে ভাঁড়ামি থাকে। একটা কথা মনে রাখবেন, কৌতুক এবং ভাঁড়ামি এক জিনিস নয়। ’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ইয়াফি খুব বিনতি নিয়ে বলেন, ‘আমি দেশে মীরাক্কেলের চেয়েও ভিন্ন ধরনের স্ট্যান্ডআপ কমেডি শো করতে চাই। কিন্তু তার আগে যা বললাম ওই পয়েন্টগুলো উঠিয়ে দিতে হবে। তাহলে দেখবেন আমাদের দেশের প্রতিভা বের হয়ে আসবে। জনপ্রিয় হয়ে উঠবে স্ট্যান্ডআপ কমেডি। ’

আমাদের চা খাওয়া শেষ হয়। আড্ডাও শেষ হয়। হাস্যোজ্জ¦ল ইয়াফি মাঝখানে আমাকে দু-চারটা কৌতুকও শুনিয়ে ফেলেছেন। হাসতে হাসতে বের হয়ে এলাম। মনে হলো, এ পৃথিবীতে এখনো বহু মানুষ আছেন যারা শুধু মানুষকে হাসানোর জন্য চেষ্টা করে যান। এজন্যই হয়তো এ পৃথিবীটা এখনো অনেক সুন্দর।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।