ঢাকা, সোমবার, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০২ জুন ২০২৫, ০৫ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

আফগানিস্তানের গ্রামজুড়ে তালেবান রাজত্ব

জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২৯, অক্টোবর ১২, ২০১১
আফগানিস্তানের গ্রামজুড়ে তালেবান রাজত্ব

যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমণের পর এক দশক পেরিয়ে গেছে। অভিযানের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তৎকালীন তালেবান সরকারের পতন ঘটেছে।

কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়নি। বরং অনেক গ্রামজুড়ে এখনো চলছে তাদের রাজত্ব।

সম্প্রতি এসব গ্রাম ঘুরে এসেছেন একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক। তিনি বর্ণনা করেছেন সেখানে তালেবানের প্রভাব এবং সমর্থন সম্পর্কে।

তার বর্ণনায় একটি ঘটনা এরকম :

মরুভূমিতে তখন প্রবল বাতাস। বালু উড়ছে। ফাঁকা মাঠে চোখে কাপড় ও হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা একটি লোক মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। একটু পরেই হত্যা করা হবে তাকে।

ছোটখাট একটা জমায়েতকে ঘিরে রয়েছে পিঠে ও কোমরে গ্রেনেড বাঁধা একদল তালেবান জঙ্গি। তাদের অনেকের হাতেই ক্যামেরাওয়ালা ফোন। আর তাদের একজনের কাছ থেকেই পাওয়া গেছে এই ঘটনার ছবি।

এক পাশে তিনটি বোরকা পরা কমবয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে। এরা তাকে হত্যা করবে। লোকটি তাদের চাচা। তিনি তাদের বাবা-মা ও দুই ভাইকে হত্যা করেছেন। গ্রামবাসী জানান, ওই মেয়েগুলির মা অসামাজিক কাজে জড়িত ছিলেন। তার স্বামী এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ওই লোকটি লজ্জায় ও রাগে পুরো পরিবারকে বহনকারী গাড়িতে গুলি চালায়।

রক্তের বিনিময়ে রক্ত, এই আইন অনুযায়ী লোকটিকে হত্যা করা হবে। তালেবান যোদ্ধারা মেয়েগুলোকে একটি ভারী কালাশনিকভ রাইফেল চালাতে সাহায্য করছিল।

এই মৃত্যুদণ্ড দেখার জন্য বহু মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিল। একটি এনজিও নির্মিত কমিউনিটি সেন্টারের ছাদে তারা ঠাসাঠাসি করে অবস্থান করছিল। এখানে তালেবানরা একেবারে নির্ভয়ে বিচরণ করে।

ওই জমায়েতের একজন জানান, লোকটিকে এভাবে গুলি করে মারার জন্য সবাই খুব খুশি।

তিনি বলেন, ‘এই এলাকার ২০-৩০টি গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করে তালেবান। তারা চোর ধরে। তারা যা করে লোকেরা তা পছন্দ করে। সরকার তো অপরাধিদের শাস্তি দেয় না, কিন্তু তালেবানরা দেয়। ’

আফগানিস্তান আক্রমণের ১০ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু ন্যাটো এখনও তালেবানদের পরাজিত করতে পারেনি। দেশটির পশ্চিমে হেরাত থেকে মাত্র ৬০ মাইল দূরে তাদের এই প্রভাব দেখেই তা বুঝা যায়।

আফগানিস্তানের বহু মানুষই চায় না যে তালেবানরা আবার ফিরে আসুক। আফগান জাতির জীবনে এই তালেবানরা আবারও কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারলে যে কী মূল্য দিতে হবে এই ভেবে অনেকেই বেশ উদ্বিগ্ন। যদিও কারজাই সরকার চাইছে নরমপন্থী তালেবান নেতাদের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে।

তবে এটা নির্ভর করছে যুদ্ধক্ষেত্রে ন্যাটোর সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর। দক্ষিণাঞ্চলে তারা তালেবানকে দ্বিতীয়বারের মতো হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চল যেমন, পুবে জঙ্গিরা তাদের অবস্থান শক্ত করেছে।

যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে একাধিক জঙ্গির কাছে জানা গেছে, ন্যাটোর বোমা হামলায় আত্মীয়-স্বজন হারানোয় তারা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে আবার অনেকেই যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। তবে তারা বলছেন, ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ করবেন।

কারও কারও আত্মবিশ্বাস আবার অসম্ভব রকম দৃঢ়। একসময় ন্যাটো ও আফগান বাহিনীর ভয়ে যেসব এলাকায় তাদের লুকিয়ে থাকতে হতো, সেসব এলাকায় এখন তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারবে। যুদ্ধে জয়ের ব্যাপারে তারা খুবই আত্মবিশ্বাসী।

সারি পুল প্রদেশে মাত্র ৭-৮ মাস আগে তালেবানে যোগ দেওয়া এক আফগান মোল্লা মুশক আলম বলেন, ‘আমি তালেবানে যোগ দিয়েছি, কারণ বিদেশিরা আমাদের অনেক লোক হত্যা করেছে, তারা কুকুর দিয়ে আমাদের বাড়ি তল্লাশি করেছে, তারা আমাদের নারী এবং শিশুদের খুব অপমানজনকভাবে তল্লাশি করেছে। আমি তালেবানে যোগ দিয়েছি, এই দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের কারণে। ’

তিনি জানান, তার দুই ভাই এবং এক চাচা ন্যাটোর বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। যখন তারা মৃতদেহগুলো বাড়ি থেকে বের করছিল তখনই তিনি তালেবানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

মুশক আরও বলেন, ‘খালি আমি নই, এরকম আরও অনেকে আছে। তালেবানে যোগ দেওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গ্রামে যেখানে মাত্র ১০ জন তালেবান ছিলেন এখন সেখানে তালেবানের সংখ্যা ১০০ জন। ’

ভাই আফগান সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন এমন এক তালেবান সদস্য রহিমুল্লাহ (২০) জানান, ১৬ বছর বয়সে তিনি তালেবানে যোগ দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে তিনি তার ভাইয়ের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেই অবিশ্বাসীদের সঙ্গে মিলবে তার বিরুদ্ধেই তিনি অস্ত্র ধরতে প্রস্তুত।

আত্মঘাতী বোমা হামলাকে তিনি সমর্থন করেন কি না জানতে চাইলে বলে, ‘এ কাজের জন্য আমরা কোনো মানুষকে বাধ্য করি না। মানুষ ধর্মের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চায়। ’

তার ভাই আবদুল রশিদের সঙ্গে কথা জানা যায়, তিনি কোনো আদর্শিক দায় থেকে সেনাবাহিনীতে চাকরি নেননি। এখানে এসেছেন শুধু টাকার জন্য। তিনি কোনো পক্ষকেই সমর্থন করেন না। তবে ন্যাটো বাহিনীকে তিনি কাফের (অবিশ্বাসী) বলেই মনে করেন এবং জঙ্গিদের ভয় পান।

রশিদ জানান, অনেক প্রদেশে বিশেষ করে রাতে বেলা তালেবানরা বেশ দাপটের সঙ্গেই চলে।

অবশ্য ন্যাটোর দাবি, অবস্থা ভালোর দিকেই যাচ্ছে। চলতি বছরে সারা দেশে সহিংসতা ৭ শতাংশ কমেছে। সবচেয়ে অস্থিতিশীল প্রদেশগুলোর মধ্যে একটি হেলমান্দে সহিংসতা কমেছে ২৭ শতাংশ।

তবে সম্প্রতি রাজধানী কাবুলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভয়াবহ হামলা নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এতে বলা যায়, তালেবান জিতেনি কিন্তু তারা একেবারে হারেওনি।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।