ঢাকা, বুধবার, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৪ জুন ২০২৫, ০৭ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

প্রবাসীর দুঃখগাথা

একজন কাদেরের গল্প

মুস্তাইন সুজাত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৫৮, অক্টোবর ১৬, ২০১১
একজন কাদেরের গল্প

এক

মধ্যরাতের আকাশ। ওপর থেকে দেখছি নিচে হাজারো বাতি ঝলমল করছে।

পাশের ভদ্রলোক বললেন, কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। তার ঠিক অল্প সময় পরেই প্রচণ্ড শব্দে বিমান বাংলাদেশ ফ্লাইটটি মাটি স্পর্শ করল। ঘড়িতে তখন লোকাল সময় রাত সাড়ে ৯টা ।

বিমান থেকে নামার পর ইমিগ্রেশনে যাওয়ার আগে সবাইকে দাঁড় করানো হলো এককাতারে। শুধু বাঙালিদের রেখে অন্যদের যেতে দেওয়া হলো। তরুন পুলিশ অফিসাররা এক এক করে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে তাদের এ দেশে আগমনের কারণ জানছে। আমার কাছে এসে বিস্তারিত জানার পর সব কাগজপত্র দেখতে চাইল। আমি ভার্সিটির অফার লেটার, রিসার্চ এসিসটেনশিপ লেটার দেখালাম। সব দেখেশুনে আমাকে ছেড়ে দিল। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে লাগল প্রায় ঘণ্টাখানেক।

এরপর থেকে সকালের জন্য অপেক্ষা। অচেনা অজানা জায়গা তাও আবার ভিনদেশ। তাই ওয়েটিং করিডোরে চুপচাপ বসে আছি। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো চারদিক । পাশেই এক লোককে দেখতে পেলাম মোবাইলে জোরে জোরে বাংলায় কথা বলছেন। সেই সাথে চরম টেনশনে পায়চারি করছেন । জানতে পারলাম ওরা বাংলাদেশ থেকে এ দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে । একই ফ্লাইটে আসা ৫ জন বাংলাদেশিকে আটকে দিয়েছে ইমিগ্রেশন । আর ওই পাঁচজন ওনারই লোক । আসলে উনি একজন আদম ব্যবসায়ী । সোজা কথায় দালাল।

কোট-টাই পড়া ভদ্রলোককে দেখে চেনার উপায় নেই । দালাল শব্দটা শোনার পর ভদ্রলোক সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ল । তাছাড়া কেন যেন এই ‘দালাল’ শব্দটার মাঝে হঠকারিতা, ধোঁকাবাজি আর শঠতার গন্ধ পাই, ঠিক বুঝি না । আর এই দালালদের হাতে পড়েই শত শত বাংলাদেশি নানাভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন, হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত । তাদেরই একজন আব্দুল কাদের, যার সাথে আমি তিনি মাস কাটিয়েছি একই বাসায় (সাবলেট ছিলেন)। এখন একটা শপিং কমপ্লেক্সে কাজ করেন ।

দুই

ঢাকা বিক্রমপুরের ছেলে আব্দুল কাদের । পাড়াগাঁয়ের মানুষ । বয়স ৩০/৩২ বছরে0র মধ্যে । বাঁচার তাগিদে এ দেশে আসেন ৩ বছর আগে । নিজ হাতে বানানো বাবার ভিটের ওপর নুতন ঘরটা বিক্রি করে এখানে এসেছেন । বাংলাদেশে যে আদম ব্যবসায়ীর মাধ্যমে আসা তাকে দিতে হয়েছে নগদ ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা । ইমিগ্রেশান পার করে দেয় তাদেরই নিযুক্ত দালাল । আর এই দালালরা সবাই বাংলাদেশী । তারপর যার যার পথ খুঁজে নেওয়া । অনেকে আবার কাজ দেওয়ার শর্তেও শ্রমিক পাঠায়, আবার অনেকে নিজে সাথে করে নিয়ে আসে । আব্দুল কাদের এ দেশে আসার পর দীর্ঘ ৫ মাস বেকার ছিলেন । টুকটাক কাজ করে চলেছেন আরও ৬/৭ মাস । এরই মাঝে এক দিন লোক মারফত খোঁজ পেলেন আরেক দালালের। সে স্বদেশীদের কাজের ব্যবস্থা করে দেয় । যোগাযোগ করলে আব্দুল কাদেরকেও কাজ ঠিক করে দেবে বলে আশ্বাস দিল ওই দালাল । তবে এর জন্য দিতে হবে ২০০ রিঙ্গিত । কাজের খুঁজে হন্যে আব্দুল কাদির তাতেই রাজি । যদি কাজটা মেলে। কথামতো একদিন সকালে তল্পিতল্পাসহ রওনা দিলেন দালালের সাথে দেখা করতে। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখেন আরও গোটা ছয়েক বাংলাদেশী এসেছেন, সবাই কাজের সন্ধানী । কিছুক্ষন পরে দালালের সাথে দেখা । সে সবার কাছে ২০০ রিঙ্গিত করে চাইল । দেশি মানুষ ভেবে সবাই অগ্রিম টাকা দিয়ে দিল । এখন আব্দুল কাদেরের পকেটে মাত্র ২ রিঙ্গিত অবশিষ্ট । দালাল বলল মালিক আসবে, তার সাথে কথা হয়েছে, আজই কাজে জয়েন । তাই কোনো চিন্তা নেই । সকাল দুপুর গড়িয়ে বিকাল। মালিক আসার কোনো নাম নেই । সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে দালাল হঠাৎ সবাইকে বলল, মালিক আসছে। ঐ রাস্তার মোড়ে আছে । আমাকে ফোন দিয়েছে, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি । সেই যে গেল, আর ফিরে এল না সেই দালাল ।


তিন

আব্দুল কাদেরের মনে দুঃখ, স্বদেশী মানুষ হয়ে কীভাবে এই কাজটা সে করতে পারল! অল্পশিক্ষিত আব্দুল কাদেরের কথায়, ‘ঐ দালাল কি অন্য কেউ? ওরা আমাগো বাংলাদেশী। তয় ওরা মানুষ না ভাই । ওরা অসৎ, ওরা জাওরা, ওগো জন্মের ঠিক নাই । ’ সেই সাথে এক পশলা অকথ্য গালি বের হয় তার মুখের বুলি হয়ে । চোখে প্রচণ্ড ঘৃণা, সেই সাথে ঠোঁটে শ্লেষের হাসি নিয়ে শেষে বলে, ‘ভাই কিছু মনে কইরেন না, একখান কথা বলি ওরা কিন্তুক বাঙালি !’  

তারপরও খেয়ে না খেয়ে প্রবাসে নিজের একটা জায়গা খুঁজে নিতে চাইছেন আব্দুল কাদেররা। আর এমন গল্প খোদ মালয়েশিয়াতেই আছে হাজার হাজার। অন্য দেশে না জানি কী অবস্থা!  

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।