মামুন বিএ পাশ করেছে বছর চারেক আগে। লেখাপড়া শেষ, কি করবে তাই ভাবছিল।
এমন নানা প্রশ্ন ভর করে তার মনে। মামুনের পিতা আইয়ুবুর রহমান দিনাজপুরের বিরল উপজেলার একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ১৯৭১ সালে। সে সময় স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশ স্বাধীন হবে। কাজের অভাব হবে না। স্বনির্ভর হবে দেশ। কিন্তু স্বাধীনতার এতো বছর পরেও দেশের বেহাল দশা কাটেনি। ফলে নিজের ছেলেরও চাকরি জোটে না। দিনগুলো কাটে গোমরা মুখে। শেষে পরিবারের সবাই সিদ্ধান্ত নেয় মামুনের বিষয়ে। সবার ইচ্ছে মামুন যাবে কোরিয়া। বিদেশের মাটিতে কাজ করে টাকা পাঠাবে দেশে। কিন্তু মামুনের স্বপ্ন ভিন্ন। সে দেশে থেকে নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। এ নিয়ে পরিবারের সাথে চলে মনোমালিন্য।
কি করবে মামুন? আয় নেই; তাই কারো কাছে কদর নেই। সবার ব্যবহারে মামুনেরও মনে দাগ কাটে। নানা দুঃচিন্তা আর অলস সময় কাটে মামুনের। বিরল উপজেলার ঠিক সামনেই মামুনের বন্ধু নজরুলের কম্পিউটারের দোকান। এক সকালে মামুন মন খুলে নজরুলকে জানালো বেকারত্বের কষ্টের কথা। বন্ধু নজরুলের পরামর্শে মামুন আসে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপজেলা কার্যালয়ে। সেখানে বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণের নানা তথ্য জানতে পারে সে।
দিনাজপুরে তখন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বাছাই প্রক্রিয়া চলছে। নিয়ম মেনে গবাদিপশু, হাঁসমুরগি পালন, মৎসচাষ, কৃষি ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক তিন মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণের যেতে আবেদন করে মামুন। নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করে নজরুলও। উপজেলা বাছাইয়ে চুড়ান্তভাবে চারজনের মধ্যে মামুনও মনোনিত হয়। দিনাজপুর জেলার কাশিপুরের যুব প্রশিক্ষণে কেন্দ্রে শুরু হয় মামুনের তিন মাসের আবাসিক প্রশিক্ষণ। থাকা খাওয়া সরকারের। দেশের প্রতিটি জেলায় রয়েছে এরকম প্রশিক্ষণকেন্দ্র। প্রশিক্ষণে চাই শুধু মনোযোগ আর পরিশ্রম । মামুন তাই করে।
দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে অনেকেই আজ যুব প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতে শিক্ষকতা করছে। সেখানে বেকার যুবকদের হাতেকলমে শিখানো হয় প্রশিক্ষণের সবকিছু। কয়েকদিনের মধ্যেই মামুন শিক্ষকদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। এ গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়ে অন্য একদিন মামুন ফিরে তার বাড়িতে। হতাশার কালো মেঘ তখন উবে গেছে তার চেহারা থেকে। সে এখন জানে কি করবে? কিভাবে করবে এবং কিভাবে টাকা উপার্জন করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যাবে। বাড়ি ফিরেই মামুন জানায় তার পরিকল্পনাটির কথা। বড় একটি মুরগির ফার্ম গড়ে তুলবে। শুনেই বাবা আইয়ুবুর রহমানের মন খারাপ হয়। বিএ পাশ করে নিজের ছেলে দিবে মুরগির ফার্ম! সমাজে তার মান থাকবে কি? নানা চিন্তা ভর করে মনে।
মামুন বাবাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলে। কোন কাজই তো তুচ্ছ নয় । শিক্ষিত যুবকেরা কৃষিতে ভালো করবে। ছেলের আগ্রহ দেখে বাবা আইয়ুবুরও রাজি হয়। ছেলের পাশে দাঁড়ায় মামুনের মুক্তিযোদ্ধা পিতা। একলাখ টাকা নিয়ে মামুন শুরু করে বয়লার মুরগির ফার্মটি। সেড তৈরি করে প্রথম ব্যাচে ২০০ মুরগি নিয়ে শুরু করে সে। প্রথম ধাপেই মারা পড়ে ৫০টি মুরগি। সে ব্যাচে লাভ তেমন হয় না। মামুন তাতেও পিছু হটে না। যাচাই করে নিজেকে। কী কী সমস্যা ছিল প্রথম ব্যাচে। সেগুলো মাথায় রেখে ৫০০টি মুরগির বাচ্চা নিয়ে শুরু করে দ্বিতীয় ব্যাচ। এবারে তার লাভ হয় ৫০০০টাকা। এভাবেই পথ চলা শুরু। মামুনের হতাশ জীবনে মনোবল বাড়তে থাকে।
মামুনকে এখন সবাই একনামে চেনে। গ্রামের লোকেরা বেকার যুবকদের উৎসাহিত করতে উদাহরণ টানে মামুনের। মামুনের এখন ৫ হাজার মারগির একটি ফার্ম হয়েছে। ফার্মে কাজ করছে আরো ৫ জন বেকার যুবক। প্রতিমাসে তার নিট আয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। মামুন এখন পরিকল্পনা করছে মাছ চাষসহ আরো কিছু প্রকল্প গ্রহণের।
কিন্তু কারা বদলে দিল মামুনের জীবনকে? কর্মের উত্তাপে বেকারত্বের জমানো বরফ গলানোর কাজটি কারা করছে? মামুনের ভাষায়, ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বদলে দিয়েছে আমার জীবনের গতি। ’
মামুনের মতো এমন হাজারো বেকার যুবকদের জীবন বদলে দিতে নিঃশব্দে কাজ করছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রশিক্ষণের পরে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া, যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করে যুবক্লাব গঠন, ক্লাবের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম গ্রহণসহ সার্বিকভাবে যুবকদের মাধ্যমে স্বনির্ভর দেশ গড়াই এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রতিটি উপজেলাতে আছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। সেখানে পাওয়া যায় প্রশিক্ষণ ও ঋণ সংক্রান্ত সকল তথ্যাদি। প্রশিক্ষণের জন্য আবেদনও করতে হয় সেখানে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের খবর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু তা ছাড়াও বিভিন্ন যুব ক্লাব বা স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হয় পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিসারি, কৃষি, ব্লক বুটিক, হাতের কাজ, নার্সারি প্রভৃতির ৭ থেকে ১৫ দিনের ভ্রাম্যমান প্রশিক্ষণের। যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে তারা সহজেই বিনামূল্যে পেতে পারে এই সরকারি সেবা। উভয় প্রশিক্ষণে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী। প্রশিক্ষণ শেষে নিজের খরচে যে কোন প্রকল্পের ৭০% কাজ করার পর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সহজশর্তে ঋণ পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণধারি যুবক সর্বচ্চো পঞ্চাশ হাজার এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণধারিরা সবোর্চ্চ পচিশ হাজার টাকা ঋণ সুবিধা পেতে পারে। দশ ভাগ কম সার্ভিস চার্জে ঋণ পরিশোধ করতে হয় মাসিক কিস্তিতে দুবছরে।
এছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ সনদ থাকলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঋণ পাওয়া যায় কর্মসংস্থান ব্যাংকসহ অন্যান্য
ব্যাংকেও। কৃষি বিষয় ছাড়াও কম্পিউটার সায়েন্স, সেলাই, ব্লক-বুটিক, হাউজ ওয়ারিং, টিভি-ফ্রিজ-রেফরিজারেটর ও মোবাইল বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে। তাই শুধু চাকরির উপর নির্ভর না করে যে কোন যুবকই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তৈরি করতে পারে নিজের আয়ের পথটি। মামুনের ভাষায়, ‘আমাদের দেশের ছেলেরা বিদেশে গিয়ে অতি নিম্নমানের কাজ করতে পারে অথচ নিজের দেশে নিজের জমিতে কাজ করতে তাদের সংকোচ বোধ করে’। তার মতে, ‘যুবকদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। তা আনতে পারলে পরিশ্রম আর মেধা দিয়েই অনেক কিছু জয় করতে পারবে এদেশের যুবকেরা। ’
শুধু তাই নয়, যুবকদের জন্য আশার খবর দিচ্ছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। বর্তমানে সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ও সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। মাধ্যমিক এবং তদুর্ধ্ব পর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন যুব ও যুবমহিলাদের জাতি গঠনমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে অস্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরিই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী এই কর্মসূচি চালু করা হয়। এর আওতায় তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয় বেকার যুবকদের। যাদের যোগ্যতা ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাস এবং বয়স ২৪ বছর তারাই এই কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারে। ইতিমধ্যে গোপালগঞ্জ, বরগুনা ও কুড়িগ্রাম জেলা এই কর্মসূচির আওতায় আছে। বর্তমান অর্থ বছরে রংপুরের কাউনিয়া ও পীরগঞ্জ, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, নীলফামারীর ডিমলা, দিনাজপুরের ফুলবাড়ি ও খানসামা, পঞ্জগড় সদর, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা এই কর্মসূচির আওতায় এসেছে। দুই বছর মেয়াদি এ চাকরিকালীন প্রকল্পে প্রতি মাসে বেতন হিসেবে ছয় হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। আর প্রশিক্ষণ চলাকালে তিন মাস প্রতিদিন একশত টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয়। তাই উল্লেখিত জেলাগুলোর যুবকেরা সহজেই পেতে পারে ন্যাশনাল সার্ভিসের সুবিধাগুলো।
এছাড়া সারা দেশে সফল যুবকদের পুরস্কৃত করা, যুব ক্লাবকে অনুদান প্রদান, যৌতুক বিরোধী অভিযান, মাদকের কুফল সম্পর্কে যুবকদের অবহিতকরণ এবং ক্লাব ভিত্তিক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। তাই তার চিন্তা কি? ঝেড়ে ফেলুন সব হতাশা। চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছে আর ছোটা নয় ।
যুক্ত হোন সরকারের যুব উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে। নিজেকে তৈরি করুন একজন সফল ও স্বাবলম্বী যুবক হিসেবে।
ছবি : সালেক খোকন
www.salekkhokon.me