ঢাকা, বুধবার, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৪ জুন ২০২৫, ০৭ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

পাখিদের অভয়ারণ্য

ফেরদৌস আহমেদ, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:৫৪, অক্টোবর ১৭, ২০১১
পাখিদের অভয়ারণ্য

চারদিকে জল আর জল। একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের গাঁওগেরামের দৃশ্যপট জলের ওপর দেড় থেকে দুই ইঞ্চি পরিমাণ চোখে ভাসে।

গভীর জলে মাছের অভয়ারণ্যের সাংকেতিক চিহ্নগুলো নিশ্চিহ্ন হয়েই ডুবে আছে। শরতের যাই যাই সময়ে আশপাশের গাছগাছালি, ভেটর পাতা, পদ্মফুল আর জলের বুক পাখিবিহীন।

ঋতুটি শরৎ তবু কাশফুলের ছিটেফোঁটাও নেই। কিছু পদ্মফুল ও মাঝে মাঝে জলজ উদ্ভিদ ফুটে আছে জলের শরীর বেয়ে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে দু-একটি অপরিচিত পাখির উঠবস ও পাখা ঝাপটানোর দৃশ্য। কালো জলের মাঝে ঢেউ খেলে যাওয়া দিনের পড়ন্ত সূর্যের কিরণ এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে সন্ধ্যার আগমনী আকাশে। এই দৃশ্যই এখন দৃশ্যমান পর্যটকবিহীন সমগ্র বাইক্কা বিলজুড়ে।

কাঁদামাটির স্পর্শ নিতে নিতে ধুলোর পথ পাড়ি দিয়ে যাত্রার সূচনা করতে হবে। বাইক্কা বিলে যেতে হলে পথের শুরু থেকে মেঠোপথের দু ধারে দেখা মিলবে মৎস্যখামার, জলের ওপর বিছানো জাল, ফুলসমেত কলমিলতা, নাম না জানা বুনোফুল, কচুরিপানার সমাহার ইত্যাদি। গোধূলি লগ্নে দেখা যেতে পারে মহিষের গুইট (পাল) এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখানে মৎস্যপেশার পাশাপাশি অনেকেই মহিষের দুধের ব্যবসা শুরু করেছেন হাওর, পানি ও ঘাসের সুবিধা পেয়ে। বিলের পাড়ে ভাসমান মানুষের জোটবদ্ধভাবে ঘর বানিয়ে বসবাসের দৃশ্য চোখে পড়বে।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাওরবেষ্টিত এলাকার নাম বাইক্কা বিল। বিলটি মাছের জন্য যত না বিখ্যাত তারচে বেশি বিখ্যাত পাখিদের অভয়ারণ্যের জন্য। এই বিলে শীতের শুরু থেকে শেষভাগেও ঝাঁকে ঝাঁকে দেশীয় ও অতিথি পাখি আসতে থাকে। তখন বাইক্কা বিলের পাড়ে, জলে অতিথি পাখির কিচির-মিচির শব্দ কানে ভাসে। অতিথি পাখি বেগুনি কালেমের পদচারণায় মুখর এখন বাইক্কা বিলসহ আশেপাশের এলাকা।

বাইক্কা বিলের পাড়েই দর্শনার্থী টাওয়ার রয়েছে। এই টাওয়ারের ওপরে দাঁড়ালে সম্পূর্ণ বিল চোখে পড়ে। এছাড়া টাওয়ারের ওপর থেকে দর্শনার্থীদের ছবি তুলতে সহজ হয়। তবে এখানে পাখি মারা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলে জানালেন কেয়ারটেকার জব্বার মিয়া।

জব্বার মিয়া নায়ের বৈঠা ঠেলতে ঠেলতে বাংলানিউজকে জানান, শীত মওসুমে দেশী-বিদেশী দর্শনার্থী পদভারে মুখর থাকে বাইক্কা বিল ও আশপাশের এলাকা। পাখি দেখার পাশাপাশি ৫০ টাকায় বাইক্কা বিলের পাখি, পদ্মফুল, মাছ ইত্যাদির একটি ভিডিও ফুটেজ কিনতে পাওয়া যায় এখানেই। এই বিলে গত বছর সবচেয়ে বেশি এসেছিল অতিথি পাখি বেগুনি কালেম। এছাড়া পাতি সরালী, ধলা বেলেহাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, মরচে রং, ভূতি হাঁস, দাগী ঘাসপাখি, ভুবনচিল, শংখচিল, পানাসী, করঈগল, বাংলা শকুন, বড় গুটি ঈগল, পাতি পান মুরগী, নেউপিপি, মেটেমাথা টিটি, পাতি চ্যাগা, দেশী কানি বক, গো বগা, লালচে বক, কালামাথা কাস্তেরা, ছোট পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখির বসবাস সারা বছর জুড়েই রয়েছে। তবে সংখ্যায় অতি নগণ্য।

বাইক্কা বিলে পাখি ও মাছের জন্য একটি স্থায়ী অভয়াশ্রম রয়েছে। এই অভয়াশ্রমের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বড় গাঙিনা আরএমও এবং সহযোগিতায় রয়েছে মাচ প্রকল্প। বাইক্কা বিলে মাছ রয়েছে ঘনিয়া, কালি বাউস, রিটা, বোয়াল, ফলি, চিতল, কানি পাবদা, শোল, রাণী, টাকি, সরপুঁটি, মলা, নামা, চান্দা, কই, তারা বাইম ইত্যাদি মাছ।      

বিলের পাশে লইয়ারকুল গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মৃত ঠাকুর মিয়ার বাড়িটি প্রায় সারা বছরই থাকে পাখিতে ভরপুর। বাড়িটি ইতোমধ্যে ‘পাখিবাড়ি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। শীত মওসুমে বাড়িটি পাখির উৎসব চলে। তখন পাখির রাত্রিযাপন নিরুপদ্রব করতে বাড়ির লোকজন পালা করে পাহাড়া দেয়। রাত যত গভীর হয় পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ ও ডানা ঝাপটানোর প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ বণ্যপ্রাণী সেবা ফাউণ্ডেশনের চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জন দেব বাংলানিউজকে জানান, পাখি ও মাছের জন্য বিখ্যাত এই বাইক্কা বিলে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এছাড়া পাখিদের খাবার ও নিরিবিলি পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

পর্যটকদের নিরাপত্তা ও বিনোদনের ক্ষেত্র তৈরি করে রাজস্ব বৃদ্ধিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে তিনি মতামত দেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।