ঢাকা, বুধবার, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৪ জুন ২০২৫, ০৭ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

স্বপ্নের পথে সুরুজ মিয়ার চল্লিশ বছর

ফেরদৌস আহমেদ, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪১, অক্টোবর ১৯, ২০১১
স্বপ্নের পথে সুরুজ মিয়ার চল্লিশ বছর

মৌলভীবাজার: সবাই থামলেও তিনি থামেননি। থেমে থাকার মন্ত্র তার জানা নেই।

অর্থ না থাকলেও দৈহিক ও মানসিক শ্রম দিয়ে আগলে রেখেছেন বিদ্যালয়টি।

ষষ্ঠ শ্রেণী পাশ সুরুজ মিয়া (৭০) চল্লিশ বছর ধরে স্বপ্ন দেখছেন এলাকার অবহেলিত দিনমজুরের সন্তানরা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হবে, মানুষ হবে। দেশের সম্মান বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরবে।

তাই যুবক বয়সে ছন, বাঁশ ও টিন দিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় নিজ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। শিক্ষকের দায়িত্বও নেন নিজ কাঁধে। সেটা উনসত্তর কিংবা সত্তর সাল। সেই থেকেই মানুষ গড়ার সাধনায় তিনি দিনের সবটুকু সময় ব্যয় করেন এলাকার অভাবগ্রস্থ পরিবারের কোমলমতি ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।

এলাকায় অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি থাকলেও সমাজের হয়ে এই দায়িত্বটিকে  কর্তব্যজ্ঞানে পালন করে যাচ্ছেন সুরুজ মিয়া একাই।

তবে মনে আক্ষেপ- শিক্ষার্থীদের বুকে আগলে রাখলেও পারেননি তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে দিতে, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে, বিদ্যালয়টির সীমানা প্রাচীর আর খেলার মাঠ দিতে। তাই তিনি সরকার, এনজিও এবং বিত্তশালী হৃদয়বানদের সাহায্য কামনা করেছেন।    

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের কালেঙ্গা বাজারের পাশে তার স্বপ্নের ওসই কালেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান।

এলাকার প্রায় শতভাগ মানুষই দিনমজুর। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অভাবগ্রস্ত ও গরীব মানুষরা এখানকার সরকারি খাস জমিতে বসতি গেড়েছে সেই পাকিস্তান আমল থেকে।

সুরুজ মিয়া বাংলানিউজকে জানান, তিনি একজন বাউলশিল্পী এবং তথ্য অফিসে মাসে দশ দিন বা তারও বেশি দিন সরকারের প্রচারণামূলক গান করতেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। তার আদি বাড়ি ভারতের আগরতলায়। পিতার নাম মৃত আবজর আলি।

চার ছেলে ও কন্যার পিতা সুরুজ ১৯৬৫ সালের দিকে মা-বাবাসহ বাংলাদেশে আসেন, আবাস গাড়েন কালেঙ্গা এলাকায়। সরকারের খাস জমিতে ঘর তৈরি করে শুরু করেন নয়া জীবন।

সরেজমিনে কালেঙ্গা বিদ্যালয়ে গেলে সুরুজ মিয়া বাংলানিউজকে বিদ্যালয় তৈরির ইতিবৃত্ত জানান এভাবে: ১৯৬৯/৭০ সালে তিনি গ্রামে একটি বিদ্যালয় স্থাপনের তাগিদ অনুভব করেন এবং পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় ছন-বাঁশ দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করেন। শুরুতে এলাকার প্রায় ১০০ জন ছাত্র বিদ্যালয়ে পড়তে আসে এবং তিনি শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। সেই থেকে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু।

১৯৭০ সালে যখন ভোটার তালিকা তৈরি হয় তখন এলাকার মানুষ রহিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজ মিয়ার কাছে দাবি করেন বিদ্যালয়ের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য।

পরে চেয়ারম্যান ৪০ ফুট লম্বা দুই কক্ষের একটি টিনশেডের ঘর নির্মাণ করে দেন। তখন থেকে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

এ অবস্থায় প্রায় ২৬ বছর চলার পর ১৯৯৬-৯৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় পাকা তিনটি কক্ষ ও একটি অফিস কক্ষ নির্মাণ করা হয়। একশ’ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য চলনসই করে নির্মিত বিদ্যালয়টিতে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর স্থান সংকুলান না হওয়াতে ২০০৯-১০ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কালেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আনুভূমিক কক্ষ সম্প্রসারেণের আওতায় আরও একটি ভবন নির্মাণ করে দেয়।

তারপরও শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান চাপে স্থান সংকুলান হয় না বলে জানান সুরুজ মিয়া।

বিদ্যালয়ে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে ৭৬৮জন। প্রধান শিক্ষকের পদটি খালি। নয়জন শিক্ষকের স্থানে ছয়জন কর্মরত আছেন। বিদ্যালয়টি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবুল কালাম চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা, বাউন্ডারি দেওয়াল ও খেলার মাঠ নেই।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আছমা বেগম জানান, বিদ্যালয়টিতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বিশুদ্ধ পানির অভাব এখন প্রকট। টিউবওয়েল থাকলেও পানি উঠছে না।

এছাড়া শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে এবং কালেঙ্গা বাজারের পাশে বিদ্যালয়টির অবস্থান হওয়ায় শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার দিক ভেবে বিদ্যালয়টির বাউন্ডারি দেওয়াল নির্মাণ করা খুবই জরুরি বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফজলুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের প্রথান শিক্ষকের পদটি অতিসত্তর পূরণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ’

এছাড়া স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অ‍ফিসের সঙ্গে বৈঠক করে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন বলেও তিনি জানান।

বাংলাদেশ সময়: ১732 ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।