ঢাকা, বুধবার, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৪ জুন ২০২৫, ০৭ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যাদের পেশা

ফেরদৌস আহমেদ, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:২৬, অক্টোবর ২৩, ২০১১
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যাদের পেশা

ভদ্রলোকেরা এখানে প্রয়োজন ছাড়া প্রবেশ করেন না। অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বা বাধানিষেধ রয়েছে।

কিন্তু ভদ্র পরিবেশের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার বেশির ভাগই এখানে রয়েছে। তারপরও কেউ স্বেচ্ছায় এখানে আসতে চান না।

কারণ তার `নিম্নবর্ণের`। আর তাই এখানে বসবাসকারী মানুষদের অবজ্ঞা করা হয়ে থাকে। সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা এদের দেখলে নাক সিঁটকায়। প্রতিবেশীর সহানুভূতিও এদের ভাগ্যে জোটে না। ধর্মীয় কাজেও এরা বৈষম্যের শিকার খোদ নিজ ধর্মের মানুষের কাছ থেকেই! এরা হচ্ছেন ধাঙড় সম্প্রদায়ের মানুষ। সমাজে অস্পৃশ্য! যাদের বলা হয় ‘মেথর’। শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাই এদের কাজ, পেশা।

এদের হাতের স্পর্শ ছাড়া শহরের পরিবেশ থাকে নোংরা। শহরবাসীর জীবনযাত্রা সুস্থ, স্বাভাবিক রাখতে এরা নিজেদের হাত লাগিয়ে ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন।

অথচ এরা সমাজের সবার কাছেই থাকেন অবহেলিত, বঞ্চিত। কারণে-অকারণে শহরবাসী এদের জাত-সম্প্রদায়ের নাম ধরে গালিগালাজ করেন। বংশপরম্পরায় অবহেলিত, বঞ্চিত থেকে এরা জাতপেশাকে আগলে রেখেছেন কোনোমতে।

একসময় ধাঙড় সম্প্রদায়ের লোকজন খুপড়ি পল্লীতে বসবাস করতেন। লোকে যাকে ‘মেথরপট্টি’ বলে জানেন। যুগের পরিবর্তনে সরকার দেশের কোথাও কোথাও এদের জন্য নির্দিষ্ট জমি নির্ধারণ করে পাকা ঘর বানিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যার সার্বিক দেখাশোনা করে পৌর কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় ভাষায় এদের ‘মেথর’ বলে পরিচিত হলেও আভিধানিক অর্থে এরা ‘ধাঙড়’। ইংরেজিতে এদেরকেই বলা হয় ‘সুইপার’। এরা ‘হরিজন’ সম্প্রদায়ের লোক বলেও নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন।

মৌলভীবাজারেও এই হরিজন সম্প্রদায়ের মেথরপট্টি রয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের ক্লাব রোড থেকে শহরতলির মাতারকাপনের পৌরসভার ডাম্পিং এলাকায় ঘর নির্মাণ করে এদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ ওখানকার নাম দিয়েছে ‘পৌর সেবক নিবাস’। তবে এলাকাবাসীর কাছে এটা ‘সুইপার কলোনি’ নামেই পরিচিত।

এই সেবক নিবাসের একটি কক্ষে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০০৯ সালের ১৮ এপ্রিল বিদ্যালয়টি উদ্বোধন করেন পৌর মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৮-১০ জন।   কেউ কেউ পঞ্চম শ্রেণী শেষ করে অন্য জায়গায় গিয়ে ভর্তি হয়।

এই সেবক নিবাসের বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষিকা ধাঙড় সম্প্রদায়ের চঞ্চলা ভাষ্প বাংলানিউজকে জানান, বিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য বই, খাতা, কলমের বড়ই অভাব। এখানকার সব শিক্ষার্থীই ধাঙর সম্প্রদায়ের। এদের পরিবারের কর্তার বেতন কম থাকায় সংসারের খরচ শেষে তাদের লেখাপড়ার সরঞ্জামাদি কেনার টাকা আর থাকে না।

অবহেলিত এই পল্লীতে তবু লেখাপড়া চলছে বলে জানান তিনি।

ধাঙর সম্প্রদায়ের সেবক নিবাসে গেলে যে কেউই বিস্মিত হয়ে যাবেন। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে ধাঙড় বা হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশ জুড়ে এক লাইনে কোটা করে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। দোতলা ঘরও আছে। এখানে ৩০টি কোটায় ৩২টি পরিবারের বসবাস। কলোনির সামনে গেলেই দেখা মিলবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশের।

ঘরগুলোর সামনের বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চারা লাগিয়ে বাগান তৈরি করা হয়েছে। কোনো কোনো ঘরের ভেতর থেকে পুরনো হিন্দি বা এ সময়ের নতুন গানের সুর ভেসে আসছে। ছিমছাম পরিবেশ। দোতলা ঘরের একটু পুবদিকে একটি মাঝারি পুকুর রয়েছে। দুর্গন্ধহীন পরিবেশ। তারপরও শহরের সভ্য সমাজের অনেকেই এখানে ভুলেও ঢোকেন না।

আলাপকালে সেবক নিবাসের প্রধান জমাদার কান্তিলাল ভাষ্পর বাংলানিউজকে জানান, কেউ কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। কেউবা আবার সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

কান্তিলালের ভাষায়, ‘সমাজের মানুষ আমাদের ঘৃণা করেন, এড়িয়ে চলেন। মর্যাদা দেন না, সম্মানও করেন না। তাই অনেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই পেশাকে ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। ’

মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন বাংলানিউজকে জানালেন, ‘ধাঙড় সম্প্রদায়ের লোকজন যেহেতু পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত; তাই পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের অনেককেই স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘শহরের আনাচে-কানাচে বিচ্ছিন্নভাবে যারা বসবাস করছেন, তাদেরকেও ক্রমান্বয়ে ঘর দেওয়া হবে এবং সেবক পল্লীর কক্ষের বিদ্যালয়টি আরও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। ’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।