বিশাল মাঠ। ওপরে শামিয়ানা।
পুরো প্রাঙ্গণের যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় গানের দল, শোনা যায় গানের সুর। সব মিলিয়ে অন্য এক গানের ভুবন। গানের ভুবনের এমন দৃশ্যেরই দেখা মেলে মরমী সাধক ফকির লালন শাহের মাজার প্রঙ্গণে।
১৬ অক্টোবর ছিল মরমী সাধক লালন শাহর ১২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে স্মরণ করেই ১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর তাঁর তীর্থস্থান কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার লালন মাজার প্রাঙ্গণে লালন সাধক, বাউল, ভক্ত ও অনুরাগীদের এই মিলনমেলা বসে। লালন একাডেমি চার দিনের এই স্মরণোৎসবের আয়োজন করে।
স্মরণে সাঁইজি
চার দিনের লালন স্মরণোৎসব শুরু হয় ১৬ অক্টোবর বিকেলে লালনের মজারে পূর্ণপাত্র নামানোর মধ্য দিয়ে। পূর্ণপাত্রে কয়েক প্রকার ফুল থাকে। গামছায় মোড়ানো এই পাত্রটি কয়েকজন লালন সাধক মাজারের বাইরে থেকে মাথায় করে এনে মাজারের ভেতরে লালনের কবরের কাছে এলে মাজারের খাদেম পাত্রটি তাঁদের মাথা থেকে নামিয়ে রাখেন। এর মাধ্যমেই শুরু হয় সাঁইজির স্মরণোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
এলাহি আল মিম গো আল্লাহ বাদশা আলমপনা তুমি
কালী নদীর তীরে লালনমঞ্চে রাত ৯টায় শুরু হয় উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উৎসবের উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল আবদুল করিম শাহ। তিনি ‘এলাহি আল মিম গো আল্লাহ বাদশা আলমপনা তুমি’ গান গেয়ে গানের আসর শুরু করেন। এছাড়া ছয় বছর পর এবার উৎসবে গান গেয়েছেন লালনশিল্পী ফরিদা পারভীন। এরপর একে একে লালন একাডেমির শিল্পীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লালন সাধক, বাউল ও শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।
জয়ধ্বনিমুখর আখড়া চত্বর
স্মরণোৎসবে কেবল লালন মঞ্চেই গান হয়নি। মঞ্চের বাইরে লালন আখড়া চত্বরেও ছোট ছোট দলে লালন সাধক, বাউল ও ভক্ত-শ্রোতারা জমজমাট গানের আসর বসান। এছাড়া লালন মাজারের পাশে নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে এবং তরিকতে আহলে বাইত বাংলাদেশের আয়োজনে বিশ্বাস পাড়ায় বসে লালন গানের আরও দুটি আলাদা আলাদা আসর ও সাধুসঙ্গ।
তিন পাগলে হলো মেলা
লালন স্মরণোৎসবে লালন সাধক, বাউল ও ভক্তদের ভাব-সঙ্গীতের পাশাপাশি লালন মাঠে এবারই প্রথম মাসব্যাপী লোক ও কারুপণ্যের মেলা বসেছে। নানা পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজির হয়েছেন বিক্রেতারা। ছেলে-বুড়ো সব ধরণের ক্রেতাও আসেন বেশ। এছাড়া আখড়া চত্বরের দোকানগুলোতেও গানের বাদ্যযন্ত্র বেঁচার ধুম পড়ে এ মেলায়।
নতুনত্বে সাঁইজির খোঁজ
এবার উৎসব উপলক্ষে কালী নদীর তীরে লালনের একটি দেয়ালচিত্র (ম্যুরাল) তৈরি করা হয়। শিল্পী শ্যামল ও সুষেণ এই চিত্রটি তৈরি করেন। এছাড়া এবার সাধুদের গোসলের জন্য একটি পাকাঘাটও তৈরি করা হয়েছে।
লালন আখড়ায় এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী অনেক সাধক, বাউল, গবেষক ও ভক্ত এসেছেন। তাঁদের অনেকে বেঁচেও নেই। লালন আখড়ায় আসা এই সাধুসন্তদের ক্যামেরাবন্দি করেছেন স্থানীয় আলোকচিত্রী মীর জাহিদ। তাঁর তোলা এসব আলোকচিত্র দিয়েই মাজারের পাশে অনুষ্ঠিত হয় একক প্রদর্শনী।
এছাড়া এবারই প্রথমবারের মতো কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাউল সম্প্রদায়কে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বাউলদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে মাজারসংলগ্ন মিলনায়তনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাউলদের ছবি ও নাম-ঠিকানা নেওয়া হয়।
দর্শনে লালন
স্মরণোৎসবে গানের পাশাপাশি লালন মঞ্চে প্রতিদিন সন্ধ্যায় লালনের গান, কথা, সুর ও বাণী নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের বিশিষ্ট লালন গবেষকরা আলোচনা করেন। মঞ্চের পাশাপাশি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়েও অনেক লালন সাধক, বাউল, ভক্ত ও অনুসারীরা নিজেদের মধ্যে লালনের বাণী নিয়ে তত্ত্ব আলোচনায় মেতে ওঠেন।
লালন শাহ বলে
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লালন-গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, ‘লালনের গান, কথা, সুর ও দর্শন আমাদের মানবতাবোধ, সাম্যবাদ, প্রেম-ভালোবাসা, সামাজিক রীতি-নীতি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুরাগ, প্রকৃতির দর্শন-বিচার ইত্যাদি শেখায়। ’
বাউল এনাম শাহ বলেন, ‘লালন আখড়াবাড়ির সঙ্গে আমার নাড়ির টান রয়েছে। তাই প্রতি বছর সাঁইজির টানে ছুটে আসি এখানে। এখানে এসেই পেয়েছি জগৎ-সংসারের অনেক শিক্ষা। ’
সাঁইজির বাণী
প্রতি বছর লালন স্মরণোৎসবে দেশ-বিদেশের অসংখ্য লালন সাধক, ভক্ত, বাউল ও শ্রোতা ছেঁউড়িয়াতে ভিড় জমান। এখান থেকে তাঁরা গ্রহণ করেন লালনের অমূল্য বাণী। ঢাকা থেকে এবার লালন স্মরণোৎসবে এসেছেন তরুণ লালন ভক্ত অমিত রাহমান লিংকন। তিনি বলেন, ‘লালনের গানে সাম্যবাদ, মানবতা, প্রেম-ভালোবাসা এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুরাগ শেখায়। তাই প্রতি বছর এই উৎসবে ছুটে আসি।
তবে লালন মঞ্চে অনেক খ্যাতিমান সাধক-বাউল গান করেন না বা অনেক সাধক-বাউল আগের মতো উৎসবে আসেন না। আবার লালন মঞ্চে যারা গান করেন তাঁদের অনেকে সঠিক ভাবে লালনের গান গাইছেও না। ফলে লালন গানের আসল সুর ও কথার বিকৃতও হচ্ছে। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে লালন গানের মূল কথা ও সুর। তাই এ বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। ’
চর্চায় লালন
লালনের গান ও দর্শনচর্চার প্রসারে লালন মাজার প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে লালন একাডেমি। ২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর লালন একাডেমি কমপ্লেক্স নামের এই লালন চর্চা কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বর্তমানে এই একাডেমি লালানচর্চার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে লালন অনুরাগীদের কাছে পরিচিত।
লালন স্মৃতিশালা
লালন একাডেমির অন্যতম একটি আকর্ষণ ‘লালন জাদুঘর’। ২০০৭ সালে ১৪ মে তৎকালীন জেলা প্রশাসক তালুকদার সামসুর রহমান এর উদ্বোধন করেন। জাদুঘরে আছে লালনের ঘরের দরজার কপাট, লালনের ছবি, একতারা, হুক্কাসহ বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি দুই টাকা।
সাঁইজির নামে প্রতিষ্ঠান
লালনের নামে ১৯৬৪ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। বাংলা ১৩৭০ সালের ১৩ আশ্বিন এখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খান প্রতিষ্ঠিত করেন ‘লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র’। ১৯৮৩ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ কে এম ফজলুল হক মিঞা এখানে উদ্বোধন করেন ‘লালন একাডেমি পাঠাগার’। ১৯৯৫ সালের চার অগষ্ট তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ নজরুল ইসলাম উদ্বোধন করেন ‘লালন সঙ্গীত বিদ্যালয়’।
সব মিলিয়ে লালন স্মরণোৎসব অসংখ্য লালান সাধক, ভক্ত ও অনুসারীদের মহা মিলনের উৎসব।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী থেকে শ্যামলীসহ বিভিন্ন বাস সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কুষ্টিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৩৫০ টাকা। যেতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘন্টা। যোগাযোগ : শ্যামলী বাস কাউন্টার গাবতলী। ফোন : ৮০১৪৫৩৮, মোবাইল : ০১৭১১ ৯৮৭০২৮।
থাকা ও খাওয়া
কুষ্টিয়া শহরে বেশ কটি মোটামুটি মানের এসি/ননএসি আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভাড়া একক রুম ৩০০ থেকে ৬০০ ও দ্বৈত রুম ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
যোগাযোগ : হোটেল গোল্ড স্টার, মজমপুর গেট। ফোন : ০৭১-৬১৬৭৫
হোটেল জুবলি, ০১৭১৭ ৪৮৯৩৭৪
হোটেল রিভার ভিউ, ০১৭১৩ ৯৫৪২৪৯, ০১৮২৩ ২৩১৫১৫।
খাওয়ার জন্য কুষ্টিয়া শহরে বেশ কয়েকটি হোটেল-রেস্টুরেন্ট রয়েছে। মজমপুর গেটে আছে জাহাঙ্গীর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। শামলা চত্বরে আছে পালকি রেন্টুরেন্ট, তার পাশে আছে মৌ রেন্টুরেন্টসহ বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট।
ছবি : লেখক
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১১