ঢাকা, শনিবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৭ জুন ২০২৫, ১০ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

আইরিশ ঐতিহ্যের প্রতিবিম্ব কিং জন ক্যাসল

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:১০, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১
আইরিশ ঐতিহ্যের প্রতিবিম্ব কিং জন ক্যাসল

প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বুকে। বিশ্বের প্রাচীনতম ঐতিহ্যে সম্বৃদ্ধশালী তেমনি এক দেশ আয়ারল্যান্ড।

দেশটি তার অতীত ইতিহাস, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে এতটাই দরদ দিয়ে আগলে রেখেছে তা না দেখে বোঝার উপায় নেই। বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্যাসলগুলোই (দুর্গ) এর বড়ো প্রমাণ।

আটশ’ থেকে এক হাজার বছর আগে রাজা বাদশারা আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করতো এমন সেনাকুঞ্জ বা দুগ গুলোই আজ ক্যাসল হিসেবে পরিচিত। প্রতিটি ক্যাসলেরই রয়েছে একেকটি নিজস্ব ইতিহাস ও নির্মাণগত স্বকিয়তা। এসব ক্যাসল বা দূর্গের রয়েছে মিউজিয়াম, যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় তৎকালীন শাসন ব্যবমস্থা ও যাপিত জীবনের নন্দিত বা নিন্দিত প্রতিচ্ছবি।

সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডের যে ক্যাসলটিতে আমাদের যাবার সুযোগ হয়েছে তার নাম কিং জন ক্যাসল।

দুর্গটি কিং জন ক্যাসল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেও মুলত: এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় জনের বাবা দ্বিতীয় হেনরির আমলে। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ি, এগার শতকের শেষের দিকে আয়ারল্যান্ডে এ্যাংলো নোরমানের হামলার সময়ে ব্রিটিশ রাজা দ্বিতীয় হেনরি স্থানীয় শাসক ডোমনাল মোর  ওব্রাইনের সাথে একটি রক্ষী সেনা বা দুর্গ প্রতিষ্ঠার চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তির পরই হেনরির অনুগত আরেক শাসক (লর্ড) রায়মণ্ড লি গ্রস ফিটজারল্যাণ্ড ওই হামলাকে (এংলো নোরমানের) নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলেও ওব্রাইন কে পুনঃ হামলা থেকে নিরাপদে রাখার জন্য ক্যাসল প্রতিষ্ঠার কাজ অব্যাহত রাখেন।

ব্রাইনের মৃত্যুর পর ১১৯৪ সালে এংলো নোরমানরা আবারো হামলা চালালে হেনরির পুত্র জন সেই যুদ্ধে তার এক ভাইকে হারালেও পূর্ণ শাসন ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। এ ক্যাসল বা দূর্গ তৈরির পেছনে তার বীরত্ব ও কর্মক্ষমতা দেখে তাঁর বাবা দ্বিতীয় হেনরি তাঁকে লর্ড উপাদিতে ভূষিত করেন। তাঁর নামানুসারে ক্যাসলের নামকরণ করা হয় কিং জন ক্যাসল।

টুইন টাওয়ার বিশিষ্ট এই ক্যাসল আয়ারল্যান্ডে এটাই প্রথম। বিখ্যাত এ ক্যাসলটি লিমরিক সিটির অদূরে সানন নামক একটি নদীর তীরে স্বীয় ঐতিহ্য বিন্যাসে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

দেশি-বিদেশি পর্যটক ও অনুসন্ধানীরা ক্যাসলটিকে এক নজর দেখার জন্য এসে ভিড় জমায়। পাথরে নির্মিত বিশাল কলেবরের ক্যাসলটির উত্তরমূখি সদর দরজাটি ব্যবহৃত হয় টাওয়ার দু’টির প্রধান ফটক হিসেবে। পিছনে রয়েছে বর্গাকৃতির বিশাল উঠোন, যার চারপাশ কঠিন দেয়ালে পরিবেষ্টিত। সমস্ত্র সৈন্য বাহিনীর আক্রমণ খুব সামান্যও টলাতে পারবে না এ দূর্গকে।

দূর্গের সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই দৃষ্টি কাড়বে কাঠের তৈরি কিং জনের প্রতিকৃতি। তলোয়ার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তি-আমাদের দেশের রাজা বাদশাদের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয়। প্রতিকৃতির উল্টো দিকে রয়েছে অভ্যর্থনাকেন্দ্র, যেখানে রয়েছে দুজন পেশাদারী ব্যক্তি, যারা পর্যটকদের স্বাগতম জানিয়ে ক্যাসল বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যাদি প্রদান করে থাকে। ক্যসলের ভেতরে যে মিউজিয়াম সেখানে ঢোকার জন্য রয়েছে টিকেটিং এর ব্যবস্থা, যার মূল্য স্থানীয় মুদ্রায় নয় ইউরো।

প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর বাম পাশে বাইরের দিকে তাকালে দেখা যাবে পাথরের প্রাচীরে ঘেরা উঠোনের মতো এক বিশাল খালি জায়গা, যেখানে সৈন্যসামন্তরা তাদের অস্ত্র সহ যুদ্ধের সরঞ্জামাদি রাখত। যুদ্ধ সামগ্রী সমুন্নত করে রাখা এ স্থানটিকে টাওয়ারটির পেছনে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কেউ আক্রমণ চালাতে গেলেও ক্যাসল ডিঙ্গিয়ে বা ধ্বংস করে সেখানে ঢোকা ছিল রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। টাওয়ারের পিছনাংশের এ জায়গাটির এক পাশে রয়েছে কয়েকটি সমাধি।

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ি, তের শতকের দিকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একই সঙ্গে মারা যায় ২৮০ জন লোক। প্রতিটি কবরে একত্রে সমাহিত করা হয় ১৫/১৬ জন মানুষকে। গবেষণার প্রয়োজনে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৯৯৩ সালে একটি কবর খনন করলে সেখানে ১৪ জন শিশু ও নারীর কঙ্কাল দেখতে পায়।

 

king-john-casle-01
দূর্গের সামনে লেখক

 

১১৯৯ সালে স্বহস্তে লিখিত একটি চিঠি (যা এখন অস্পষ্ট) থেকে লিমরিক তথা ক্যসলটির প্রতি তার দরদ ও ভালোবাসার কথা উপলব্ধি করা যায়। মিউজিয়ামে রয়েছে তার শানামলের ছবি সম্বলিত মুদ্রা যাকে তখন বলা হতো হাফপেনি কয়েন।

প্রত্মতাত্ত্বিকরা ক্যাসলটি খননকালে সেখানে মুল্যবান স্বর্ণখচিত তের শতকের একটি আংটি পান। সেটিও শোভা পাচ্ছে মিউজিয়ামের এক কোনে। রয়েছে মধ্য যুগে ব্যবহৃত রান্নাবান্নার জন্য বিভিন্ন বাসন-কোসন, ফুলদানি, টেবিলক্লথ ইতাদি।

মিউজিয়ামে রয়েছে গানমানি, সিলিং, কপারহাফপেনি প্রভৃতি বিভিন্ন শাসকদের শাসনামলের মুদ্রা। লিমরিক ট্রেড টোকেন নামক একটি বিশেষ মুদ্রা রয়েছে যা সাধারন মুদ্রার কমতি কাটানোর জন্য ব্যবহৃত হত। ১৬৫৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার (ব্রিটিশ লর্ড বা কিং) যখন পর্যাপ্ত প্রচলিত মুদ্রা বিতরণ করতে ব্যর্থ হয় তখন লিমরিকক ট্রেড টোকেন নামক মুদ্রাটির প্রচলন ঘটে।  

এঁটেল বা কাদামাটি দ্বারা নির্মিত এক ধরনের পাইপ ধুমপানের জন্য ব্যবহৃত হতো সপ্তদশ শতকের দিকে। মিউজিয়ামে রক্ষিত হোয়াইট ক্লে পাইপ সে আমলের সৌখিন ধূমপায়ীদের স্মৃতি বহন করে চলছে এখনো। এ ছাড়াও মিউজিয়ামের ডায়রিতে রয়েছে ষোল শতকের মাঝামাঝিতে ক্যাসলটি সৈন্যবাহিনী কতৃক অবরোধ হওয়ার গল্প। রয়েছে লিমরিক সিটির প্রথম ও প্রাচীন মানচিত্র।

আইরিশরা তাদের পুরনো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখে কেবল বিদেশীদের প্রশংসা পাচ্ছেন তাই নয়, পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবেও সম্বৃদ্ধশালী হয়ে উঠছেন। আমাদের বাংলাদেশে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যে সুসম্বৃদ্ধ হলেও একে সাবলীল ভাবে তুলে ধরে এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি আনায়নে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।  

লেখক: আয়ারল্যান্ড প্রবাসী
[email protected]
           
বাংলাদেশ সময়: ২০০১ ঘণ্টা, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।