ঢাকা, শনিবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৭ জুন ২০২৫, ১০ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

‘বাঙালি অন্য যে কোনও জাতির তুলনায় অনেক বেশি স্মার্ট’

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল, আয়ারল্যান্ড থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:২০, ডিসেম্বর ১৯, ২০১১
‘বাঙালি অন্য যে কোনও জাতির তুলনায় অনেক বেশি স্মার্ট’

বিজয়ের আনন্দের ইমেজ কাটতে না কাটতেই বিশ্ব অভিবাসী দিবস গত হয়ে গেল। গত ১৮ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব অভিবাসী দিবস।

১৯৯০ সালের এ দিনে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বের সব অভিবাসী শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার সংরক্ষণে একটি সনদ অনুমোদন করা হয়। সেই সঙ্গে দিনটিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। তখন  থেকে আমাদের দেশে সিভিল সোসাইটি দিবসটি পালন করলেও সরকারি উদ্যোগে দু’হাজার সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার এবার বেশ ঘটা করেই দিবসটি উদযাপন করেছে।

সরকারকে এ জন্য ধন্যবাদ জানানোর আগে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই সেইসব অভিবাসী ভাইবোনদের যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঐকান্তিক নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজের দেশের অর্থনীতির সাফল্যের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছেন।

একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রবাসী কল্যাণ সচিবের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে,  ‘১৯৭৩-৭৪ সালে এই খাতে বছরে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা রেমিটেন্স আসত। আর এখন সেখানে প্রতিবছর প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার রেমিটেন্স আসছে। আর্থিক বিবেচনায় এই খাত থেকে বৈদেশিক সাহায্যের ১০ গুণ আর বৈদেশিক বিনিয়োগের ১৩ গুণ বেশি অর্থ উপার্জন হচ্ছে। জিডিপি`তে এ খাতের অবদান ১৩ ভাগ। তবে বাস্তবে এটা ২০ ভাগেরও বেশি। কর্মসংস্থানের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় খাত। শুধু তাই নয়, সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৭৮ লাখ লোক প্রবাসে অভিবাসী হিসেবে আছেন বল্লেও মূলত এর বাস্তব পরিসংখ্যান কোটির নিচে নয়।

প্রবাস জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি তা হল, আমাদের বাংলাদেশি ভাইদের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা, কাজে অনীহা প্রকাশে অনিচ্ছা, সুনিপুন কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি গুণাবলী অন্য যে কোনও দশেরে কর্মীদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।

আমার এখনো মনে পড়ে, দু’হাজার সালের দিকে আমি সিঙ্গাপুর অবস্থানকালে আমার কোম্পানির মালিক এক অন্তরঙ্গ পরিবেশে আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের বাঙালিদেরকে আমি পছন্দ করি কারণ, তোমরা সিঙ্গাপুরে র্কমরত অন্য যে কোনও জাতির তুলনায় অনেক বেশি স্মার্ট। ’

সত্যি তাই। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বাঙালি অভিবাসীদের বদনাম যে নেই তা হলফ করে বলা যাবে না সত্যি। কিন্তু বিদেশি কর্মবাজারে আমাদরে সাধারণ শ্রমিকদের সুনামকে মোটেও অস্বীকার করার জো নেই। স্বীয় সুনাম ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তারা অর্জণ করতে সক্ষম হচ্ছে হাজার লক্ষ কোটি বৈদেশিক মুদ্রা যা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ও দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভুমিকা রাখছে।

প্রবাসীদের অবদানের কথা মনে করে সরকার বেশ জমজমাট করে দিবসটি পালন করতে যাচ্ছেন। সংবাদে প্রকাশ, প্রবাসী কর্মীদের জন্য এককেন্দ্রিক সেবা চালু করার উদ্দেশ্যে সরকার যে ২০ তলাবিশিষ্ট প্রবাসী কল্যাণ ভবন নির্মাণ করেছেন তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। এ ভবনে থাকবে মন্ত্রণালয়ের দু’টো অনুবিভাগ, ইমিগ্রেশন সার্ভিস, পাসপোর্ট সার্ভিস, প্রবাসীদের  জন্য ব্রিফিং সেন্টারসহ বিদেশে যেতে আগ্রহীদের সব ধরনের সেবামূলক কাজের ব্যবস্থা।

অভিবাসী দরদী বর্তমান সরকারের এ প্রশংসনীয় উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এর কার্যক্রম যেন কেবল উদ্বোধন বা কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে না যায় কিংবা ভবনটি যেন অসাধু ধূর্ত কর্মকর্তাদের সোনারখনি হয়ে না দাঁড়ায়। একইসঙ্গে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যারা আছেন তারা যেন ব্যাপারটা দায়সারা ভাবে নিয়ে বেমালুম ভুলে না যান।

অভিবাসীদের বিশেষ করে বাঙালি প্রবাসীদের অনেক দুঃখ আছে। দেশের অফিস আদালতে কাজ-কর্ম করতে গিয়ে সঠিকভাবে মূল্যায়িত না হওয়া, দেশে ফেরা বা বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন অফিসার বা কাসটম্স কর্মকর্তা কতৃক অহেতুক ঞযরানি করা, চুরি-ডাকাতিসহ স্থানীয় সন্ত্রাসি র্কতৃক হুমকি-ধামকি এমনকি প্রাণনাশ ইত্যাদি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সরকার আরও বেশি যত্নবান হলে প্রবাসীদের কল্যাণেরে সাথে সাথে সরকারের ক্রেডিবিলিটির পাল্লাটাও ভারী হবে।

প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে একটি বষিয় উল্লেখ করতেই হয়। কয়েক মাস আগে সিলেটের জগন্নাথপুর অধিবাসী ব্রটিনে প্রবাসী এক ভদ্রলোক শেষ জীবনটা নিজ দেশে কাটানোর জন্য বাংলাদেশে ফেরেন। কিন্তু দেশ ফেরার পর স্থানীয় এমপির সহায়তায় সন্ত্রাসীরা তাকে খুন করে। যা নিয়ে বাংলানিউজরে মুক্তমতে আমি লিখেছিলাম। আমার এক বন্ধু দেশে পৌছার আগেই তার বাড়িতে টাকা দাবি করে উড়ো চিঠি আসতে থাকে। ইলিয়াস ভূঁঞা নামের এক বন্ধু ঢাকার এক পল্লীতে প্লট রেখে কিস্তিতে দাম পরিশোধ করার পরও বিভিন্নভাবে হয়ারানির সম্মুখীন হয়ে দেশের আইনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এখন।
জানি এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু এসবই প্রকৃত বাস্তব যা অভিবাসীদের মনে দেশের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টভিঙ্গী সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। আশা করি সরকার এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভেবে কিংবা তুচ্ছ মনে না করে প্রতিরোধে যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন।

এ ব্যাপারে একটু ভিন্নভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। আমি যেহেতু আয়ারল্যান্ড প্রবাসী তাই এদেশে বসবাসরত বাঙালি অভিবাসীদের কিছু সমস্যার কথা তার সমীপে তুলে ধরতে চাই।

বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে ছাত্র, কর্মজীবী বা অন্যান্য বৈধ-অবৈধ পেশাদারীসহ প্রায় পাঁচ/ সাত হাজারের মতো বাঙালি অভিবাসী বসবাস করছেন। সময়ের দাবিতে এখানে গড়ে উঠেছে বাঙালি কমিউনিটি, আত্ম প্রকাশ করেছে আওয়ামীলীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জার্মান সফরে এলে আয়ারল্যান্ড থেকে আওয়ামী প্রতিনিধি হিসেবে দলটির সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম খন্দকার রানা নেত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করে অভিবাসীদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

২০০৯ সালে ব্রিটেনে বাংলাদেশ হাই কমিশনার ড. আবু সাইদ আয়ারল্যান্ডের লিমরিক সিটিতে এলে স্থানীয় বাঙালি কমিউনিটির প্রতিনিধিরা তার কাছে একটি দাবি-ই তুলে ধরেছিলেন। তা হল- আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশরে দূতাবাস স্থাপন করা। জবাবে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিকূলতার কথা বল্লেও তিনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করছেলিনে। কিন্তু অদ্যাবধি আমরা এর বাস্তবায়নে কোনও পদক্ষেপ দেখতে পাইনি।

কমিউনিটি বা রজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সকল আয়ারল্যান্ড প্রবাসী বাঙ্গালিদের সরকারের কাছে একটি-ই দাবি তা হল- যে কোনও মূল্যে এদেশে একটি দূতাবাস গড়ে তোলা। দূতাবাসের অভাবে এখানে বসবাসরত বাঙ্গালিদের বার্থ র্সাটিফিকেটসহ পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যাদি নিয়ে জটিলতার মখোমুখি হতে হয়। শুধু তাই নয়, একটি দেশ বা জাতির স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলার জন্যও দূতাবাসের ভুমিকা অপরিসীম।

২০০৭-এ মইন-ফখরুদ্দিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে কারাগারে প্রেরণ করলে আয়ারল্যান্ড থেকে বাঙালি প্রতিনিধি হিসেবে আমি সর্ব প্রথম এ অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে জনকণ্ঠ, সংবাদ, প্রথম আলো, ইনকিলাবসহ আরও কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে বিবৃতি প্রদান করি।   বিশ্ব অভিবাসী দিবসের সূত্রে তাই প্রিয় নেত্রীর কাছে ছোট্ট মিনতি, তিনি যেন আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত বাঙালি অভিবাসীদের প্রাণরে এ দাবিকে একটু দরদ দিয়ে উপলব্ধি করুন।               


লেখক: আয়ারল্যান্ড প্রবাসী
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।