ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

৯০ বছর বয়সেও ইংরেজি শেখাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন আলী

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০
৯০ বছর বয়সেও ইংরেজি শেখাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন আলী

বরিশাল:  মো. কাঞ্চন আলী সিকদার। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বয়স ৯০ বছর হয়ে গেছে। ৩৬ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এরপর অবসরে গেছেন তাও ২ যুগ হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু এখনো ছাড়তে পারেননি শিক্ষকতা। বিনা বেতনে নিয়ে চলেছেন ক্লাস।

সন্তানরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাই সংসারের খরচ নিয়ে কাঞ্চন আলীর খুব বেশি চিন্তা নেই।

 নিজের দেওয়া জায়গায় সন্তানরা মিলে প্রতিষ্ঠা করেছে কাঞ্চন শিকদার বিদ্যানিকেতন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ। এই দুই প্রতিষ্ঠানেই নিয়ম করে ইংরেজি বিষয়ে ক্লাস নেন এ মুক্তিযোদ্ধা। তাও আবার বিনা পারিশ্রমিকে।

শিক্ষার্থীদের পড়ানোতেই যেন তার আনন্দ। অপরদিকে শিক্ষার্থীরাও কাঞ্চন স্যারের ক্লাস থেকে বঞ্চিত হতে রাজি নয়। তাদের দাবি, ইংরেজি এত ভালোভাবে অন্য কোনো স্যার বোঝাতে পারেন না। আর কাঞ্চন আলী সিকদারের ইচ্ছে, দীর্ঘদিনের সঞ্চিত জ্ঞান তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন।

আলহাজ্ব কাঞ্চন আলী সিকদারের জন্ম বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার গাড়ুরিয়া ইউনিয়নের দেউলী গ্রামে। তিনি ১৯৫৭ সালে বিএ পাস করেন। পরে ১৯৬০ সালে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাঙ্গাসিয়া নলদোয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ টাকা বেতনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৭টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবসরে যান ১৯৯৬ সালে।

সহধর্মিনী বিলকিস জাহান নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও তিনিও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। কাঞ্চন আলী যেখানে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর কাজ করেছেন, সেখানে নিজের ৬ সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার কাজটি করেছেন স্ত্রী বিলকিস জাহান।

বয়স হয়ে গেছে ৯০ বছর।  এখনো ক্লাস নেওয়ার সময় চেয়ারে বসেন না কাঞ্চন আলী।  ছবি: বাংলানিউজ

৩৬ বছরের কর্মজীবন শুরু হওয়ার আগে এইচএসসি পাস করার পর পুলিশের এসআই পদে চাকরি হয়েছিলো কাঞ্চন আলীর। তবে দাদা ছদর উদ্দিন সিকদার ও বাবা মোক্তার আলী সিকদারের অনুপ্রেরণায় ওই চাকরিতে যোগদান না করে শিক্ষকতাকে বেছে নেন তিনি।

কাঞ্চন আলী বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ ৩৬ বছরের কর্মজীবনে আমি ইংরেজি ও বাংলা বিষয়ে ক্লাস নিয়েছি নিয়মিত। তবে আমার পছন্দের বিষয় ইংরেজি। এ কারণে কাউকে ইংরেজি পড়াতে পারলে ভালো লাগে। আমি যেটা জানি, সেটা যদি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারি সেটার যে আনন্দ, তার নাম বিমলানন্দ। আর আমি সেটাই চাই। আজ অবধি আমি কখনো ক্লাসে দেরি করিনি। ক্লাস নেওয়ার সময় কখনো চেয়ারে বসতাম না।

প্রবীণ কাঞ্চন আলীর কার্যক্রম প্রতিনিয়ত দেখছেন এবং তার কাছ থেকে শিখছেন স্থানীয় শিক্ষকরা। কাঞ্চন সিকদার বিদ্যানিকেতন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিহির কর্মকার বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষকতায় যে এত সম্মান তা স্যারকে না দেখলে এবং তার সন্তানদের গড়া প্রতিষ্ঠানে না আসলে বুঝতে পারতাম না। আমরাও চাই স্যারের মতো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে।

‘৯০ বছর বয়সে যেখানে মানুষ অবসর সময় পার করে সেখানে স্যার এতটাই শিক্ষানুরাগী যে, এই বয়সেও তিনি দাঁড়িয়ে ক্লাস নেন। অনেক সময় পরপর দুটি ক্লাস নিতে দেখেছি কিন্তু ওনাকে বসতে দেখিনি। ’

এই বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের মতে, সবজায়গাতে আজকে নবীনদের জয় জয়কার। এরপরও প্রবীণদেরও যে দরকার এর বড় দৃষ্টান্ত কাঞ্চন স্যার।

এই প্রবীণ শিক্ষককে নিয়ে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরাও বেশ খুশি। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার, মুক্তা আক্তার, নয়ন সিকদার, আরিফুর রহমান, রুমানা জানান- তারা অপেক্ষায় থাকেন কাঞ্চন স্যারের ইংরেজি ক্লাসের জন্য।

বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ এস এম জুবায়ের আলম বাংলানিউজকে বলেন, মানুষকে তার বয়স দিয়ে আটকানো যায় না। কোনো মানুষের উদ্যম এবং আগ্রহ থাকলে মানুষ তার নিজ কর্মগুণে জীবনকে জয় করতে পারে। আর তিনি (কাঞ্চন আলী সিকদার) সেটাই করছেন। ওনাকে দেখলে কারো মনে হবে না যে ওনার বয়স ৯০ বছর। একটানা ৯০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও ক্লাস নেন তিনি, যা অবাক করার মতো বিষয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০
এমএস/এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।