ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

৫৬ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষতি ৪৯,৫০০ কোটি টাকা

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০১ ঘণ্টা, মে ৮, ২০২০
৫৬ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষতি ৪৯,৫০০ কোটি টাকা

ঢাকা: করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষায় দেশ এখন কার্যত ‘লকডাউনে’। সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ। বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বড়, মাঝারি, ছোট সব ধরনের শিল্প খাত বিপর্যস্ত। কৃষি খাতে উৎপাদন বন্ধ না হলেও ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাত নিয়ে বেকায়দায় কৃষক। কুলি, মজুর, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল পরিমাণ মানুষের আয়ের পথ বন্ধ।

সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া অধিকাংশ মানুষ এখন অনিশ্চিত জীবনের পথে। এই অচলায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে গেছে।

প্রথমবারের মতো করোনার প্রভাবে বন্ধ সব বিপনী প্রতিষ্ঠান। ফলে ৫৬ লাখ ক্ষুদ্র ব্যসায়ীর প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ১১০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ০৯ মে মোট ৪৫ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

পাশাপাশি ফ্যাশন হাউজের বিক্রি বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন দেশের তাঁতশিল্প ও অ্যামব্রয়ডারি খাতের উদ্যোক্তা-কারিগররা। আর মোট অর্থনীতিতে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে লকডাউনে দিনে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে। কাঁচামালের অভাবে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানার উৎপাদন সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রাণঘাতী করোনা প্রাদুর্ভাবের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে যতো দেরি হবে, আমাদের বাণিজ্য আগের অবস্থানে ফিরতেও ততো দেরি হবে। এরই মধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি খাতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের কারণে রমজান কেন্দ্রিক ব্যবসায়িক আয়োজন নিষ্প্রভ। নেই চিরচেনা সেই উৎসবের পরিবেশ। অবরুদ্ধ পরিবেশ, আয়-উপার্জনের সীমাবদ্ধতা, বৈশ্বিক বাণিজ্য চেইন ভেঙে পড়া ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে ব্যবসায়ীরা হতাশ। এদিকে রমজানে বিক্রির লক্ষ্যে পণ্য মজুদ করলেও লোকসানের শঙ্কায় আছেন দোকান মালিকরা। তারপরও রোজা বা ঈদের বাজার ধরতে সব দিক থেকে প্রস্তুত তারা।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।  ছবি: শাকিল আহমেদএ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো: হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, করোনায় ব্যবসায়ীক ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ এই লকডাউন কতো দিন থাকবে আমরা জানি না। আমাদের পুঁজিই নেই। তাহলে আমরা কিভাবে এই ক্ষতির হিসাব করবো। প্রায় দেড় মাস ধরে সবধরনের দোকান পাট বন্ধ। তারপরও আমরা একটা গ্রস হিসাব করেছি। তবে এটা চূড়ান্ত নয়। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লাভের ক্ষতি যদি ধরা হয় তারা গড়ে ২০ হাজার টাকা করে সেল করলে আমাদের ৫৬ লাখ ব্যবসায়ীর প্রতিদিন ১১০০ কোটি টাকার ব্যবসায়ীক ক্ষতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা এখন অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে আছি। কোথায় গিয়ে শেষ হবে আমরা জানি না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীদের বেঁচে থাকটাই বড় বিষয়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রাণঘাতী করোনার প্রভাবে দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প খাতে মোট এক হাজার ২৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে প্রতিদিন। এর মধ্যে বড় ও মাঝাড়ি শিল্পে প্রতিদিন ক্ষতি ৮১৪ কোটি টাকা। ছোট শিল্প খাতে ক্ষতি ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া বাণিজ্য খাতে (খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়) ৬৬৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে প্রতিদিন।

তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দিনে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে। ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৩১ দিনের অবরুদ্ধ অবস্থায় অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

লকডাউন অবস্থা পুরো মে মাস এমনকি জুন মাসেও অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যদি তাই হয়, তাহলে মে মাস শেষে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের মোট দেশীয় উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ।

এদিকে বাংলাদেশ সরকারও বড় অংকের (প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা) প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজ অর্থনীতিতে কতটুকু গতি ফিরিয়ে আনতে পারবে তা নির্ভর করবে স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি মোট ক্ষতির পরিমাণ এবং প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ওপর।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।  ছবি: বাংলানিউজইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শামসুল আলম সজল বাংলানিউজকে বলেন, সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা এখান থেকে কাপড় কেনে। রমজানে এই ব্যবসা বেশি হয়। বকেয়াও পাওয়া যায় এ সময়। কিন্তু প্রায় দেড় মাস মার্কেট বন্ধ থাকায় আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। সরকার যতই প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলুক না কেন, এই ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো না।

বাংলাদেশ ফ্যাশন অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, কারিগররা প্রায় শতভাগ পণ্য প্রস্তুত করে ঈদের আগেই। সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগেই মজুদ করা হয়েছিল ক্রয়াদেশের অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি পোশাক। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় শুধু পোশাক খাতে ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। বিপর্যয় দেখা দিতে পারে উৎপাদন ও সাপ্লাই চেইনে। দেশে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৫ হাজার ফ্যাশন হাউজ। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় ক্ষতির শঙ্কায় আছেন এ খাতে জড়িত অন্তত ৫ লাখ মানুষ।

দেশীয় পণ্যের অন্যতম ব্র্যান্ড আড়ং সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশই হয় ঈদে। করোনার কারণে বিক্রি বন্ধ থাকলে ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে ইয়োলো ফ্যাশনের জেনারেল ম্যানেজার (হেড অব রিটেল অপারেশন) হাদি এস এ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের মধ্যে আমাদের ৪০ দিনের ব্যবসা হয়। এ বছর আমাদের শতভাগ লোকসান হবে। ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।

স্নোটেক্সের সহকারী ব্যবস্থাপক (পিআর) শেখ রাহাত অয়ন বাংলানিউজকে বলেন, ঈদ মার্কেটের জন্য আমরা ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ করে ফেলেছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে রোজা ও ঈদের বাজার হারাবো। আমাদের আয় বন্ধ হয়ে গেলেও ব্যয় বন্ধ হয়নি।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বাংলানিউজকে বলেন, রমজানে আমাদের দেশে ফ্যাশন শিল্প খুব জোরদার থাকে। এবার তাদের ব্যবসা একেবারেই কম হবে। ইতোমধ্যেই তাদের একটা বড় ক্ষতি হয়েছে। এজন্য ই-কমার্সকে জোরদার করা হচ্ছে। যাতে তারা ঈদের বাজারটা ধরতে পারে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় চলমান লকডাউনে দিনে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ধরে ক্ষতির অনুমিত হিসাব দেওয়া হয়েছে এই সমীক্ষা প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে লকডাউনের কারণে প্রতিদিন কৃষিতে ক্ষতি হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা। শিল্প খাতে দিনে ক্ষতি হচ্ছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতির মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতে প্রতি দিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সেবা খাতে দিনে ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেবা খাতে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচা-কেনা এবং জরুরি সেবা ছাড়া এই খাত মূলত অবরুদ্ধ। সব ধরনের যোগাযোগ (সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথ), পর্যটন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, রিয়েল এস্টেটসহ সব ধরনের সেবা একেবারেই বন্ধ। স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারি অংশটিতেও এক প্রকার অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে সেবা খাতে প্রতি দিনের অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৮ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০২০

জিসিজি/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।