ঢাকা, সোমবার, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৯ জুন ২০২৫, ১২ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

সমাজের অপরাধ নিয়ে কথা বলতে হবে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:১৮, জানুয়ারি ৭, ২০১২
সমাজের অপরাধ নিয়ে কথা বলতে হবে

বাংলানিউজ ২৯ ডিসেম্বর ‘ব্লগে সাইবার ক্রাইম...’ বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। এ বৈঠকে অংশ নেন ব্লগার এবং বিভিন্ন ব্লগের সঞ্চালকবৃন্দ।

বাংলা ব্লগ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘গণজাগরণে সোশ্যাল মিডিয়া এবং সাইবার আইন’। গণজাগরণের বিষয়ে ব্লগাররা একমত হলেও সাইবার আইন নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। এ বিতর্ক অনেকেই ‘ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ আইন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ও ব্লগগুলোতে চলছে আলোচনা সমালোচনা।

বাংলানিউজ আয়োজিত এ বৈঠকে ব্লগাররা এবং সঞ্চালকবৃন্দ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। ধারাবাহিকভাবে সে আলোচকদের বক্তব্যগুলো তুলে ধরা হচ্ছে।

এবারে প্রকাশিত হলো ব্লগার ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদের বক্তব্য।

মাহবুব মোর্শেদ:  
আমাদের দেশে ব্লগ সংস্কৃতি সামহোয়্যার ইন ব্লগ থেকে আজকে বাংলানিউজ ব্লগে এসে ঠেকেছে। সে সময়ে যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয় ব্লগে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন অপরাধ আমি দেখি কিনা;  তখন আমি বলবো ব্লগের জগতে কোনো অপরাধ নেই। ২০০৫ থেকে এই সময়ে ব্লগ ব্লগের মতই চলেছে। আমরা এখানে কথা বলেছি, অন্যের কথা শুনেছি, অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেছি।  

আমাদের রাষ্ট্র এরই মধ্যে বহু অপরাধ করেছে। বিচারের কোনো অবকাশ না রেখে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তারা কাজে লাগিয়েছে।   রাষ্ট্র অপরাধ করেছে। রাষ্ট্র গণতন্ত্র থেকে নিজেকে বিচ্যূত করেছে। রাষ্ট্রকে আমরা দেখেছি, সরকারগুলোকে দেখেছি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখেছি। তারা ভয়াবহ সব অপরাধ করেছে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখেছি তারা নানান ধরনের কু-প্রবণতা দিয়ে নানান ধরনের অপরাধ করেছে।  

আমাদের সমাজে অপরাধ কী? আমাদের সমাজে হত্যা-খুন-ধর্ষণ-ইভ টিজিং হচ্ছে। এখানে বখাটেদের অত্যাচারে মেয়েরা আত্মহত্যা করছে। সুতরাং আমাদের সমাজে অপরাধের ধারণা কিন্তু অনেক পোক্ত। আমাদের সমাজে চুরিকে সচরাচর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না; যদিও সেটা অপরাধ।  

যখন আমি রাস্তায় বের হচ্ছি তখন বাড়িতে ফেরার স্বাধীনতা যেখানে আমার নাই। বাড়িতে ফেরার যে নিশ্চয়তা সেটা আমার নাই। তখন ব্লগে একটা নিক খুলে কে কাকে গালি দিল সেটা এখানে বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। আমাদের অপরাধ সহ্য করার ক্ষমতা অনেক। আমি বলবো যে, আজকে রাস্তায় বের হয়ে আমি যানজটের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি;  রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি। গাড়ি এগুচ্ছে না। এই অপরাধ কার? এ প্রশ্ন তো আমরা সরকারের কাছে কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রশ্ন করতে পারছি না।  

সমাজে আরো অনেক অপরাধ আছে যেগুলো নিয়ে ব্লগারদের এখন কথা বলাটা জরুরি। গত ছয় বা পাঁচ বছরে ব্লগের যে কালচার তা অত্যন্ত ভালো এবং অপরাধহীন। ব্লগে খুবই সুন্দর পরিবেশ এবং ব্লগে আমরা একটা সামাজিক পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি। কমিউনিটি ব্লগের যে আইডিয়া সেটা এখন শুধু নাম না এটা এখন একটা কালচার হয়ে গেছে। আমাদের এখানে আমি মাহবুব মোর্শেদ যদি ফুল লতা পাতা নিক খুলে ব্লগে এসে গালি দেই; তখন আমি এই নিক নিয়ে প্রচন্ড সমালোচনার সম্মুখীন হবো। আমাকে মানুষ খারাপ মানুষ হিসেবেই জানবে।  

যে লোকেরা ছদ্মনাম নিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ব্লগে এসে পরিবেশ নষ্ট করে তারা কিন্তু এখানে সমাদৃত নয়। বরং আমরা দেখেছি যারা ইতিবাচকভাবে লড়াই করেছেন, সমালোচনা করেছেন তারাই কিন্তু এখানে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং ব্লগে নয় ব্লগের বাইরেও তারা সমাদৃত হন। রাষ্ট্র তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তরুণ প্রজন্ম ব্লগের মাধ্যমে বিকল্প মাধ্যম কিংবা বিকল্প সংবাদ মাধ্যম গড়ে তুলেছেন। এটা কিন্তু ব্লগের অবদান। আজকে কেউ যদি গুগলে বাংলা লিখে সার্চ দেন তখন আপনাকে নিয়ে যাবে সামহোয়্যার ইন ব্লগে বা অন্য কোনো ব্লগে। অথচ রাষ্ট্রেরও অনেক সাইট আছে; অনেক কনটেন্ট আছে।  

তাহলে কেন? এই যে রাষ্ট্র বা সরকার যাদের কথা বলছি তারা কী কনটেন্ট দিচ্ছে? বাংলায় কিছু সার্চ দিলে তাদের কোনো ওয়েবসাইটে তো নিয়ে যাচ্ছে না। নিয়ে যাচ্ছে ব্লগে। ব্লগাররা যে কনটেন্ট ছড়িয়ে দিচ্ছেন সেটাই কিন্তু আমরা পাচ্ছি। ফলে এই অবদানটা অনেক বড় একটা অবদান।  

আমি বলব যে সাইবার ক্রাইম এবং এই আলোচনা নিয়ে আমার একটা সমালোচনা আছে। আমি আসার পথে শুভ্রকে বলছিলাম,  ব্লগে সাইবার ক্রাইম নিয়ে কেন আমরা আলোচনা করবো? মানে এই প্রশ্নটা কেন উঠছে? এই প্রশ্নটার উত্থাপনটা কীভাবে হলো? আমাদের এখানে একজন মন্ত্রী বলেছেন ব্লগে যাই খুশী তাই হবে সেটা চলতে দেওয়া যাবে না। যা খুশী তাই বলবে সেটা বলতে পারবে না। এখানে আইন হওয়া দরকার। আমাদের সমাজে শুনেছি এটার একটা প্রতিধ্বনি হয়েছে।  

সবচেয়ে বিস্ময়কার ব্যাপার হলো আমাদের মন্ত্রী যেদিন বলেছেন,  ব্লগে আমার এবং সরকার দলীয় সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধী দলীয় মহাসচিবের নামে কুৎসা রটানো হচ্ছে। ঠিক তার কয়েকদিন পরে ভারতের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী কপিল সিবাল বলেছেন, ‘ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ ফেসবুকের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াচ্ছে। তাই ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ’ এখন এই কথাগুলো সচরাচর শোনা যাচ্ছে।  

ফেসবুকে যেখানে হাজারটা কাজ হচ্ছে, হাজার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, হাজার কথা হচ্ছে কিন্তু একদিন কবে কখন কোথায় একজন রাজনৈতিক নেতার ছবি বিকৃত করে প্রকাশ করেছেন সেটা নিয়ে পুরা ফেসবুকের উপর তারা দায়টা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।   তারা এই দায়টা চাপিয়ে প্রচার করতে চায় যে ব্লগে ফেসবুকে যা হচ্ছে সব খারাপ হচ্ছে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ হলো এটাকে বন্ধ করে দেওয়া। সে উদাহরণ কিন্তু আমরা পেয়েছি। বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ইউটিউব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।  

আমাদের দেশের সরকারগুলো সাধারণ জনগণের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। এমনকি সরকারের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ভালো তাদেরও সমালোচনা সরকার সহ্য করতে পারে না। একারণে ব্লগের সমালোচনা তো তারা সহ্য করতেই পারবেন না।  

আমাদের দেশের গণতন্ত্র অনেক দূর্বল। এটাকে আরো শক্তিশালী করা দরকার। সেটার জন্য একটাই উপায় হলো আরো গণতন্ত্র চর্চা করা। গণতন্ত্রকে আইন দিয়ে, বাধা দিয়ে কোনোভাবেই রুখা সম্ভব না। মিডিয়াকে উন্মুক্ত করতে হবে। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। মানুষকে কথা বলতে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই আমাদের রাষ্ট্রে গণতন্ত্র কায়েম করা যাবে।  

ভারতে যখন কপিল সিবাল ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন তখন সেখানকার মিডিয়াতে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। আমরা দেখেছি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যখন বললেন তখন আমাদের মিডিয়া প্রত্যাশিতভাবেই ততটা সরব হয়নি। কিন্তু কথা হওয়া উচিত ছিল। এবং ওই সময়ে ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিনে একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। সেখানে বলেছিল, ‘আপনারা ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন কেন? আজকে আমাদের চায়ের টেবিলে যে আলোচনা হয় সেটা নিয়ন্ত্রণের কথা কি তুলতে পারবেন? টি-শপের আলোচনারও তো গুরুত্ব আছে। সেখানে তো অনেক লোক যায়। সেখানে তো তীব্র কণ্ঠে সরকারের সমালোচনা হয়। তাহলে সরকার কী টি-শপ পুলিশ পাঠিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবে? সেটা কী সম্ভব?’

সুতরাং ব্লগে মানুষ কথা বলবে। কথা বলতে দেওয়াটাই হলো বাস্তবতা। ব্লগে আমরা কী অপরাধ করেছি সেটা নিয়ে আমরা নিজেরা আলোচনা নিশ্চই করবো কিন্তু সমাজে আরো অনেক বড় বড় অপরাধ আছে যেগুলো নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।