ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১০ জুন ২০২৫, ১৩ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

যেদিন পুরুষ থাবা মারবে না...

ফারজানা খান গোধুলী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৩৪, মার্চ ৭, ২০১২
যেদিন পুরুষ থাবা মারবে না...

গতকাল সকালে জাকিয়ার (বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট জাকিয়া আহমেদ)  ই-মেল, গোধুলি আপা, নারী দিবসের জন্য লেখা চাই, সময় একদম নাই, খুব তাড়াতাড়ি একটা লেখা পাঠান। বিষয় হতে পারে আপনার গল্প।



ই-মেল টা পড়ার পর মাথার মধ্যে টিক করে উঠল একটা কথা, আমার এ পর্য়ন্ত আসার গল্পটাই আবার করি না কেন? অনেক বার করা হয়েছে তবুও এটাই সহজ। বেশি ভাবনা চিন্তা করা লাগবে না। লাইন বাই লাইন মুখস্ত। সুপার ট্রেনের গতিতে লিখে যাবো, একাধিক বার জবাইকৃত মুরগি আরও একবার জবাই দেবো। সকাল ১২টা পর্যন্ত ঠিক ছিল সব কিছু একরকম। ১২টার পরের ঘটনাতে বদলে গেলো সব ভাবনা। সে কারনে আমার মনে হল আমার কথা অনেকে জানে। আমার গল্পের থেকে অনেক বেশি দরকার সমাজের আনাচে কানাচে আমার দেশের মেয়েদের নিয়ে লেখা। আমাদের বাঙালি মেয়েদের নিয়ে লেখা। আমার লেখাই একটা দুটো মেয়ে যদি নিজের জীবন নিয়ে ভাবে, তার থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?

 অবাক হই যখন দেখি ২০/২১ বছর ধরে আমেরিকায় বেড়ে উঠা, এখানে লেখা পড়া করা, ভালো চাকরি করা মেয়ের সাথে, আমার বাংলাদেশের সুবিধা বঞ্চিত প্রত্যন্ত  অঞ্চলের অশিক্ষিত মেয়ের বিবাহিত জীবনের খুব একটা পার্থক্য নাই। অবাক হই যখন দেখি পি এইচ ডি ডিগ্রিধারী ভদ্দরলোক, স্বামী অন্ত:প্রাণ স্ত্রী কে পেটায়। পরনারীর প্রতি আসক্তি প্রকাশ পায়, তখন আমাদের দেশের ভদ্দর লোকের মুখোশধারী নারী নির্যাতনকারী ভণ্ডগুলোর চেহারা মনে ভাসে। মনে হয় বউ পেটানো রাক্ষস পৃথিবীর সবখানে।

 অনেকদিন পর আবহাওয়া বেশ উষ্ণ। রৌদ্র উজ্জ্বল দিন, ঝকঝকে নীল আকাশ। সামার সামার ভাব। মনটা খুশিতে নেচে উঠল। তখন সকাল ১১টার দিকে মেয়েটাকে পাতলা জ্যাকেট পরিয়ে একটা বল নিয়ে বাড়ির সামনের ইয়ার্ডে বের হলাম। আইয়ান বাইরে খেলতে, বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করে। আমিও। যারা শীতপ্রধান দেশে বাস করে, তারা শীতের দিনে উষ্ণ দিন পাওয়াটাকে বোনাস পাওয়ার মত মনে করে। দিনটাকে সেলিব্রেট করে, যদি দিনটা উইক এন্ডে হয়। নাতিশীতোষ্ণ দেশের মানুষ আমি। দীর্ঘ শীতের মাঝে এমন উষ্ণ দিন, আমাকেও আনন্দিত করে, হোক সে সপ্তাহের যে কোনও দিন। আইয়ান মহা খুশি, এদিক দৌড় দেয়, ওদিক দৌড় দেয়। মাঝে মাঝে দৌড় রাস্তার দিকে। আমাদের রাস্তাটা নো আউটলেট, ফলে গাড়ির যাতায়াত কম। আর এলেও নেইবারহুডে ধীরে চালায় সবাই। এ কারণে চিন্তা কম। আর সপ্তাহের শুরু হবার কারণে একদম ফাঁকা, তিন চার বাড়ি ছাড়া সবাই অফিসে। আমরা মা মেয়ে মহা উৎসাহে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছি। আমাদের জিপকোডে মাত্র ৪/৫ জন বাঙালি। আর সৌভাগ্যক্রমে একজন আমার একদম পাশের বাড়ির। এই বাড়ির ভদ্রলোক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে আছেন, বউ ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস। আধুনিক মনস্ক কিন্তু ইসলামিক জীবনযাপন তাদের। হাসি খুশি সুখী পরিবার। এই বাড়ি ভদ্রলোকের নাম সাহিক ও বউটার নাম নাহিদা। এদের সাথে আমাদের খুব ভাব। বিশেষ করে নাহিদা আপা ও আমি খুব দ্রুত দুইজন বন্ধু হয়ে গেছি।

উল্লেখ্য, সাহিক ভাই পারকিনসন্স রোগে ভুগছেন ৬ বছর ধরে। উনার পোশাকটাও পরিয়ে দিতে হয় নাহিদা আপাকে।

 আইয়ান দৌড় দিয়ে নাহিদা আপাদের ইয়ার্ডে চলে যায়। আমি ওকে আনতে গিয়ে বেল বাজাই ওদের দরজার। দেখি দরজা খোলা। তারপরও আমি বেল বাজাই, উপর থেকে সাহিক ভাই জানান নাহিদা বাসায় নাই। যদিও নাহিদা আপার গাড়ি ড্রাইভওয়েতে। গাড়ি ছাড়া আমাদের এ শহরে চলাচল বেশ কঠিন। তাই সবারই দুই/তিন/চারটা গাড়ি। আমি আর আইয়ান ফিরে আসি আমাদের ইয়ার্ডে। তখনই দেখি পুলিশের দুইটা গাড়ি আমাদের রাস্তায় ঢুকছে, গাড়ির লাইটবার বন্ধ। ধীরে ধীরে গাড়ি দুইটা নাহিদা আপার বাড়ীর সামনে থামল। আমাদের দিকে পুলিশ হাই করে ওদের বাড়ি ঢুকল এবং অন্য পাশের বাড়ি থেকে নাহিদ আপা বের হয়ে পুলিশের সাথে বাড়ি ঢুকলেন, আমার দিকে তাকালেনও না। আমি অবাক, ওদের বাড়িতে পুলিশ কেন? এদেশে অন্যের প্রতি কৌতূহল দেখানো অশোভন; তাই তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকি আমরাও। কিছুক্ষণ পর আমি নাহিদ আপাকে এসএমএস করি, I saw few cops in your home. Let me know if you need my help I can come right now. উনি জানালেন, we r ok. আধা ঘণ্টা পর উনি আমায় ফোন করে জানালেন যে, সাহিক ভাই উনাকে মেরেছেন, তাই নাহিদা আপা পুলিশ ডেকেছেন। পুলিশ নাহিদা আপার নিরাপত্তার জন্য সাহিক ভাইকে বাসা থেকে বের করে দেয়। ফোন রেখে আমি উনার বাসাই যাই। নাহিদা আপাকে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তাকে জড়িয়ে ধরতেই আপা বাচ্চাদের মত করে কাঁদতে লাগলেন।
শান্ত হবার পর আমি জিজ্ঞাসা করলাম হঠাৎ কেন মারলেন? আপা বলেন ,‌‌ ‘হঠাৎ না ১৬ বছর ধরে মার খাচ্ছি। গতকাল রাতে অন্য নারীর প্রতি আসক্তির প্রমান হাতে নাতে পেলে ঝগড়া চরম আকার ধরণ করে, এরি মাঝে গায়ে হাত তোলে সাহিক । এতদিন মার খেয়েও সংসার করছিলাম, হাসি মুখে ছিলাম বাচ্চাদের দিকে চেয়ে। কিন্তু কেন মানবো পরনারীর প্রতি আসক্তিকে? এই কারণে পুলিশকে ফোন করেছি। সবার কাছে ওর খারাপ দিকগুলো লুকিয়েছি এতদিন। কি পেলাম তার বদলে? অন্যায় করে বার বার মাফ চেয়েছে, কান্নাকাটি করেছে, তাকে বারবার সুযোগ দিয়েছি ভালো হবার, কিন্তু সে আরও বেশি খারাপ হইছে। আমার আলাদা হবার দিন চলে এসেছে, বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা হয়ে যাবো। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন, সমাজ ও চক্ষুলজ্জায় মুখ বুজেছিলাম। কিন্তু পরনারীর প্রতি আসক্তি কথা জেনে আর পারলাম না চুপ করে সহ্য করতে। ’

বাড়ি ফিরে আসি মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। খুব অস্থির লাগে, এতো পড়াশোনা, এতো ম্যানার, এতো টাকা পয়সা কোন কিছুই পারে না নাকি মানুষ কে সুখী করতে? নিজের সবকিছুকে কে জলাঞ্জলি দিয়ে কোন সুখের পিছনে ছোটেন, যে সুখ দুমড়ে মুচড়ে ফেলে সংসার? মান-সম্মান, সমাজ কোনও কিছুই থামাতে পারে না কি এই নেশা? বিবেক জাগে সব শেষ হয়ে যাবার পর। সারাদিন এক লাইন লেখা হয়নি। মনই দিতে পারিনি। দুইতিনবার চেষ্টা করেও লিখতে পারিনি। বার বার ঘুরে ফিরে নাহিদা আপার হাসি মুখ আর কান্নাভেজা মুখ মনে পড়ছিল। রাতে ল্যাপটপের সামনে বসে ভাবছিলাম আমাদের দেশের মেয়েরা কত কিছু সহ্য করে সংসার করে। এরই মাঝে মনে হলো নাহিদা আপার খবর নেই। ফোন করতেই জানালেন কোর্টে উনি অ্যাপিল করেছিলেন বাচ্চাদের নিয়ে একা থাকার। বিকেলের মধ্যে কোর্ট তাকে এক বছর একা থাকার রায় দিয়েছেন, বাচ্চারা তার কাছেই থাকবে, সাহিক ভাই এই একবছর বাডির ড্রাইভওয়েতেও আসতে পারবে না। আসলে অ্যারেস্টেড হবেন। এমনকি নাহিদা আপাকে ফোন করতে পারবে না। পনের দিন পর পর বাচ্চারা উইকএন্ড কাটাতে যাবে বাবার কাছে। সাহিকভাই না এলেও উনাকেই সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে। ফোনটা রেখে ভাবলাম এই কথাই কেন লিখি না। আজ যদি উপমহাদেশের মেয়ে না হয়ে অন্য কোন দেশের মেয়ে যেমন আমেরিকান, মেক্সিকান বা ইউরোপিয়ান হতো তবে ১৬ বছর কেন ১৬ দিনও সহ্য করতো না। তিলে তিলে নিঃশেষ হতো না। উল্টা কেস করে ক্ষতিপূরণ কড়ায় গণ্ডায় উসুল করে নিতো।

আমাদের উপমহাদেশীয় মেয়েদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে শেখানো হয়, মেয়ে মানে বিয়ে ছাড়া গতি নাই , যত বড় চাকরিই কর, যত লেখাপড়া কর, বিয়ের পর শুধু স্বামী না শ্বশুর বাড়ীর লোকরা যা বলবে, সেইভাবে জীবন চালাতে হবে। পুরুষই আমাদের ভাগ্যবিধাতা, বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবন আমূল পাল্টে যায় কিন্তু একটা ছেলে না চাইলে কোনও অবস্থায় তার জীবন পালটায় না। কোথায় আমেরিকায় বসবাস কারী উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি মেয়ে আর কোথায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জরিনা সখিনা সবার অবস্থা একই। স্বামীর হাতে মার খাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে নিগৃহ যেন তিন বেলা খাওয়ার মত স্বাভাবিক। নারীর প্রতি সহিংস এই মানুষগুলোর মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, সামাজিক-অসামাজিক নেই। এরা পৃথিবীর যেকোনও স্থানে থাকুক, ভালোমন্দ যেমনই থাকুক নারীর প্রতি সহিংস থাকবে। এদের নেই ন্যায়-অন্যায় বোধ, পারিবারিক ও সামাজিকভাবেই এরা সহিংস মন-মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে।

 এই নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে হলে মেয়েদের লেখাপড়া জানতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, স্বাবলম্বী হতে হবে, শুরুতেই যে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, গোপন না করে জানাতে হবে পরিবারে বাকি সদস্যদের। গোপন করলে আরো বাড়ে অপরাধ। আইনের সাহায্য নিতে হবে প্রয়োজনে। দিনের পর দিন মুখ বুজে থাকার ফল ভালো হয় না। পরিবার ও সমাজ যদি সম্পর্কের গুরুত্ব, প্রয়োজন, মূল্যায়ন ও মাধুর্যের শিক্ষা ছোট থেকে ছেলে সন্তানদের শেখায় তাহলে এই অবস্থার কিছু পরিবর্তন হবে। পরিবারই পারে সংযম শিক্ষা দিতে, ছোট থেকে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য তুলে ধরতে, সম্পর্কের গুরুত্ব ও মাধুর্য ধরে রাখা শেখাতে। সম্পর্কের গুরুত্ব ও মাধুর্য বজাই রাখা ছেলেদের বিপথগামী না হতে সাহায্য করবে বলে ধারণা করি। সেই সাথে আমরা মেয়েরা যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হই, নিজ আধিকার সম্পর্কে সচেতন হই, আমাদের সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করি, সম্পর্কের গুরুত্ব, প্রয়োজন, মূল্যায়ন শিক্ষা দিই তাহলে ধীরে ধীরে মেয়েদের প্রতি পারিবারিক অত্যাচার কমে আসবে বলে আশা করি। আশা করতেই পারি আমাদের প্রতি সহিংসতা একদিন বন্ধ হবে। নারীকে পণ্য বা শুধু ভোগের সামগ্রী ভাববে না আমাদের সঙ্গী পুরুষ। থাবা মারবে না, বাড়াবে বন্ধুত্বের হাত।

 লেখক: ফারজানা খান গোধুলি, ওয়াশিংটনপ্রবাসী সাংবাদিক।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।