ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১০ জুন ২০২৫, ১৩ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

নারী তুমি কেমন আছো!

ফজলুল বারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:৪৮, মার্চ ৮, ২০১২
নারী তুমি কেমন আছো!

জাতীয় কবি নজরুলের সেই অমর কবিতা, ‘জগতে আছে যত কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। সেই নারীর সত্যিকার অবস্থান কোথায় বাংলাদেশে এবং জগতে? প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন অস্ট্রেলিয়ার গণতন্ত্রে এই প্রথম জুলিয়া গিলার্ড দেশটার নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

কিন্তু এখনই বলা হচ্ছে তার অবস্থান যথেষ্ট নড়বড়ে। এখনই নির্বাচন হলে পড়ে যাবেন।

দুনিয়ার মোড়ল আমেরিকায় আজ পর্যন্ত কোন নারী প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। বারাক ওবামার নির্বাচনের আগে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও দলের মনোনয়ন আদায় করতে পারেননি হিলারী ক্লিনটন। তখনই বোঝা গেছে বাইরে অনেক সুবোধ-সুশীল কথাবার্তা বললেও মার্কিনীরা ভিতরে ভিতরে কতটা পুরুষবাদী অথবা নারী বিদ্বেষী! অন্তত এখনই কোন নারীকে তারা দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বসাতে রাজি অথবা প্রস্তুত না! পরিস্থিতি বুঝে অতঃপর দেশটার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ নিয়ে সন্তুষ্ট আছেন মিসেস ক্লিনটন।

তবে মার্গারেট থেচার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এশিয়ার দেশগুলোর নেতৃ্ত্বে নারী বেশ কিছুটা এগিয়ে। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, পাকিস্তানের বেনজীর ভূট্টো, শ্রীলংকার শ্রীমাভো বন্দেরনায়েক, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতী সুকর্নপুত্রী, ফিলিপাইনের কোরাজান একুইনো, আরোয়া প্রমুখ গণতান্দ্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও তাদের অধিষ্ঠান-ক্ষমতায়নের পিছনে পারিবারিক উত্তরাধিকারের বিষয়টি সম্পর্ক যুক্ত। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রী অংসান সুকি’ও পারবারিক উত্তরাধিকারের প্রতিনিধি। সার্ক দেশভূক্তদের মধ্যে এখনও শুধু নেপাল-ভূটান-মালদ্বীপে কোন নারী প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হননি।  

খোলা চোখে বাংলাদেশের ক্ষমতায় নারীর অবস্থান যে কাউকে চমকে দেবার মতো! স্বৈরাচারীর এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রথম দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর থেকে প্রতি পাঁচবছর অন্তর অন্তর প্রধামন্ত্রীর চেয়ারটি শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার মধ্যেই অদলবদল হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু মুজিব ও জিয়ার উত্তরসূরী এই দুই নেত্রী অবশ্য যার যার দলের নেতৃ্ত্বের নিয়ন্ত্রণও কঠোরভাবে ধরে রেখেছেন। দল দুটিতে তাদের নেতৃ্ত্ব চ্যালেঞ্জ করার বুকের পাঠা কারও নেই। ১/১১’র সময় যারা এক-আধটু চেষ্টা করেছিলেন, দলে-রাজনীতিতে তারা এখন মোটামুটি আধমরা অবস্থায় টিকে-বেঁচে আছেন। বলা হয় দুই নেত্রীর উপস্থিতিতে দল দুটিতে বাঘেমোষে একঘাটে পানি খায়! দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদেও কেউ পরপর দুবারের বেশি নির্বাচন করার কথা ভাবতে পারেন না। কিন্তু আমাদের দুইনেত্রী যেন আমৃত্যু স্ব স্ব দলের নেত্রী! এগুলা নাকি গণতান্ত্রিক কাউন্সিলের মাধ্যমে হয়। দু’জনেই অবশ্য এখন তাদের ছেলেদের ভবিষ্যতে দল ও শাসনক্ষমতায় বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুইনেত্রীর মনোবাসনা পূর্ণ হলে বাংলাদেশ কিন্তু আবার পুরুষ নেতৃ্ত্বে ফেরত যাবে!

বর্তমান সরকারের আমলে অবশ্য যত নারী গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্বে বসেছেন, তা এর আগে কখনো হয়নি। এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি, প্রাথমিক শিক্ষা, সমাজকল্যান অধিদপ্তর নারীর দখলে আছে! বিরোধীদলের নেত্রী, সংসদ উপনেতাও নারী। সুপ্রীমকোর্ট-হাইকোর্টের বিচারপতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদেও নারীর অধিষ্ঠান হয়েছে। দেশের চিকিৎসা, শিক্ষকতা পেশায়, পুলিশ-সেনাবাহিনীতে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়েছে। মিডিয়ায় বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সে সব জায়গাতেও নারী কর্মীদের মর্যাদা-সুযোগ সুবিধা বেড়েছে কী? সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর রুনি’কে নিয়ে কিছু কিছু মিডিয়ায় কী সব ছাপা হয়েছে? এসব কারা লিখে, সম্পদনার দায়িত্ব পালন শেষে মুদ্রণে পাঠিয়েছেন? এরা কারা? আয়নায় বন্ধুর মুখগুলো কাদের?

এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা কবরী ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী গত সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসেন। সংসদের সংরক্ষিত আসনেও বেড়েছে নারী এমপির সংখ্যা। তারানা হালিমের মতো জনপ্রিয় অভিনেত্রী, মমতাজের মতো জনপ্রিয় গায়িকাকে সংরক্ষিত আসনে এমপি করে সংসদে নিয়ে আসা হয়েছে। আলোচিত নির্বাচনে জিতে দেশের প্রথম নারী সিটি মেয়র হয়েছেন নারায়নগঞ্জের জননায়িকা ডা সেলিনা হায়াৎ আইভী। কিন্তু এতসব অর্জন সত্ত্বেও কী দেশে নারীর সতিকারের ক্ষমতায়ন, সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যায়ন বেড়েছে? উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ সমূহের নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। ‘না’ সূচক জবাব পাবেন।

এমনিতে বাংলাদেশের সমাজে-পরিবারে নারী বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। কৃষক পরিবারগুলোর নারীরা ফসল উৎপাদন-প্রক্রিয়াজাতকরণের নানাক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঘরের রান্নাবান্না, বাচ্চাদের দেখভালের পাশাপাশি তারা ফসল উৎপাদনের নানাক্ষেত্রে সক্রিয় জড়িত থাকলেও সমাজে-সংস্কারে এসবের অর্থনৈতিক গুরুত্বের কোন স্বীকৃতি নেই। কৃষি শ্রমিক হিসাবেও নারীর মজুরি কম। দেশের অর্থনীতির চলতি আরেক গুরুত্বপূর্ণ তৈরী পোশাক শিল্পেরও আশি শতাংশের বেশি শ্রমিক নারী। কম মজুরিতে নারী শ্রমিক সহজলভ্য হওয়াতেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ-প্রসার ঘটেছে। এমনকি বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকের মজুরির পরিমাণ চীন-ভারতের চেয়েও কম। এসত্ত্বেও পোশাক শিল্পে কাজ পাওয়াতে বেঁচে গেছে-টিকে আছে দেশের লাখ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবার। বাংলাদেশের গ্রাম-নগরভিত্তিক নারীজীবনের অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহের আরেক কারণ এনজিওদের ক্ষুদ্র ঋণ। ক্ষুদ্রঋণের উচ্চহার সুদ নিয়ে অনেক সমালোচনা-বিতর্ক আছে। কিন্তু রাষ্ট্র যাদের পাশে দাঁড়ায়নি, এনজিও তাদের পাশে যদি না দাঁড়াত সামাজিক দুর্যোগ-হাহাকার আরও চরমে থাকতো। সরকারের অবৈতনিক নারী শিক্ষা কর্মসূচি গ্রামের মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক মর্যাদা কী সে তুলনায় বেড়েছে? বেড়েছে কী নারীর সামাজিক নিরাপত্তা? এখনও নিত্য নারী পথেঘাটে ইভটিজিং’র শিকার হন। এসিড সন্ত্রাসসহ নানান সামাজিক সহিংসতার টার্গেট এখনও নারী। দেশের প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেত্রী নারী হলেও গ্রামে-গঞ্জে-বস্তিতে গরিব নারীরা নিত্য একশ্রেনীর মোল্লা-মৌলভীর ফতোয়াবাজির শিকার হচ্ছেন। রাজনৈতিক কারণে আবার এসব ফতোয়াবাজদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন কোন না কোন নেত্রী! সরকারের নারী নীতি যে সব মোল্লা-মৌলভী রুখে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছে, বিএনপির নেত্রী তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ধর্মের কথা বলে উত্তরাধিকার সম্পদে নারীর সমান অধিকারের বিষয়ে সমাজ, রাজনৈতিক দলগুলো এখনও একমত নয়। অথচ সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। ভোটে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকলেও সম্পদে কেন নয়? এক্ষেত্রে আমরা পুরুষরা বরাবর সুবিধাবাদের পক্ষে।

আমাদের পরিবারগুলোতে এখনও মেয়ে সদস্যরা আমাদের কাছে ‘মেয়ে’ই রয়ে গেছেন। মানুষ হননি! বেশিরভাগ মায়েরাই অবশ্য মেয়েদের মেয়ে বানিয়ে রাখেন। বাবা-মা’র কাছেও ছেলের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত মেয়ে সন্তান। এসব সত্ত্বেও বেশিরভাগ পরিবারে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করছেন। কিন্তু বিয়ে সহ নানাক্ষেত্রে এখনও মেয়েদের পছন্দের গুরুত্ব-মূল্য নেই। ঘরের ছেলেটি প্রেম করে বেড়ালেও সারা সময় খেয়াল রাখে তার বোনটা যাতে আবার প্রেমটেম না করে! নিজের পছন্দে কোন মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেললে তা সামাজিক লোক নিন্দার কারন হয়। ছেলেরা করলে সমঝোতার উদ্যোগ নেন বাবা বা মা।

এসব পারিবারিক-সামাজিক নানা বৈষম্যের ভিতরেও নিজের মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারী। রাজনৈতিক-সামাজিক নানান অগ্রগতির মধ্যেও বাংলাদেশের নারীর একটি আন্তর্জাতিক কলঙ্ক আছে। কী সেটা? এই কলঙ্কের নাম দেশান্তরী তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশের তিনদশকের নারী শাসিত সময়েও দেশের আলোচিত এই লেখিকা দেশে আসতে পারেন না। এখানে একাত্তরের খুনি যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকার নিয়ে নিত্য বাহাস হয়। কিন্তু লেখিকা তসলিমা নাসরিন যে তার জন্মভূমিতে আসতে পারেন না এ নিয়ে তার মানবাধিকার নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি,  মিডিয়া কারোরই কোন মাথাব্যথা নেই! দুনিয়ার মুক্তিচিন্তা মানুষ-মানবাধিকার একটিভিস্টদের সিংহভাগ শুধু এই তসলিমা ইস্যুতে বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের সমগোত্রীয় মনে করেন!  এবারে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলাদেশের কোন আলোচনায় এ বিষয়টি জায়গা পাবে কী? এ বিষয়টি সবাইকে মনে করিয়ে দিলাম। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের সংগ্রামী সহ সকল নারীদের শুভেচ্ছা। জীবনের সবক্ষেত্রে নারীর মর্যাদার ভিত্তিতে সমান অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হোন। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় না বলুন।  

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।