আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া): ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ এখন দেশের যে কোনো স্থানের চেয়ে বয়লার রাইস মিল সমৃদ্ধ এলাকা। নৌবন্দর, রেল ও সড়ক পথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কম খরচে প্রচুর শ্রমিক পাওয়ার কারণে এখানে এ ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।
স্থানীয় চাল কল মালিক সমিতির হিসাব মতে, আশুগঞ্জে সাড়ে তিনশতাধিক ছোট বড় বয়লার রাইস মিল রয়েছে। আর এসব মিলে কর্মরত আছেন প্রায় ১৫ হাজার নারী শ্রমিক। ধান থেকে চালে পরিণত করার আগ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে তাদের ঘাম ঝরানো শ্রম থাকে বলে এসব শ্রমিক স্থানীয়ভাবে চাতাল-নারী হিসেবে পরিচিত।
শ্রমে কোনো ক্লান্তি বা ফাঁকি না থাকলেও তাদের মজুরি খুবই নগন্য। দিনে ১৫-১৬ টাকা হারে পারিশ্রমিক দিয়ে বয়লার মালিকরা তাদের শ্রম কিনে লাভবান হচ্ছেন। বিপরীতে চাতাল-নারীরা কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।
চাতাল নারী যারা
ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলার আমতলী, ফরিদপুর জেলার নাড়িয়া এবং খুলনার কয়রা উপজেলার হতদরিদ্র নারীরা এলাকায় কাজ না পেয়ে দল বেধে আশুগঞ্জের বিভিন্ন বয়লারে আসেন। চাতালে ধান থেকে চাল করা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তারা কাজ করেন দলীয়ভাবে। চাতাল শ্রমিকরা দিন-রাত পরিশ্রম করে থাকেন।
তাদের দিনযাপন
অর্থনৈতিক দৈন্য, রোগ-শোক আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সব মিলিয়ে তাদের জীবন বড়ই মানবেতর। ছোট ছোট জরাজীর্ণ স্যাঁতসেঁতে তাদের ঘরে পৌঁছেনি শিক্ষার আলো। স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা কী তা তাদের অনেকেই জানে না।
প্রতিবছর ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে চাতার নারীদের ১৫-১৬ জন শিশু মারা যায়। বিবাহিত চাতার নারীদের গড়ে ৫-৬ জন করে সন্তান। অনেক সময় কর্মজীবি এ নারীরা স্থানীয় বখাটে ও মাস্তানদের লালসার শিকার হয়।
উদয়াস্ত পরিশ্রম
প্রতিটি চাতালে ৪০ জন নারী শ্রমিকের বিপরীতে পুরুষ থাকে ১৫-১৬ জন। একজন সর্দারের অধীনে ধান শুকানো, মিলে ধান ভাঙানো, বস্তায় চার ভরা হলো নারী শ্রমিকদের প্রধান কাজ। চাতালে ধান আনা, ধান ছড়ানো ও সেদ্ধ করা পুরুষ শ্রমিকদের কাজ হলেও নারী শ্রমিকরা ওই কাজে অংশ নিয়ে থাকে।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে একটি মাঠ উঠতে গড়ে দুদিন সময় লেগে যায়। বৈরী আবহাওয়া থাকলে তা তিন থেকে পাঁচ দিনে গড়ায়। প্রতি মণ সেদ্ধ ধান সাড়ে ৪ টাকা, আতপ চাল ৬ টাকা এবং বয়লারে ৭ টাকা হারে পারিশ্রমিক পায় নারী শ্রমিকরা। অবশ্য এ ক্ষেত্রে চালে উচ্ছিষ্ট অংশের কিছু তারা বোনাস হিসেবে পেয়ে থাকে। সঙ্গে কিছু তুষ।
তাদের দুঃখগাথা
বরিশালের চাতাল নারী জাহানারা বেগম, আছিয়া খাতুন, হাছিনা বেগম, মর্জিনা, সামসুন্নাহার এবং নুরুন্নাহার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের শ্রমে বয়লার মালিকরা আরামে থাকলেও ঈদ ছাড়া আমাদের চুলায় মাংস ওঠে না।
তারা জানান, তাদের জীবনে কোনো বাড়তি আনন্দ নেই। দিনে ১৫-২০ টাকা আয় দিয়ে সংসার চালানো খুবই কষ্ট। তাছাড়া গড় মৌসুমে বয়লার মালিকদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আগাম শ্রম বিক্রি করতে হয়। ময়লা ছেড়া কাপড়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইলেও অন্যদের কাছ থেকে অবহেলা পেতে হয়।
মজুরি বৈষম্য
খুলনার চাতাল শ্রমিক আব্দুল করিম, ছিদ্দিক মিয়া, আজিজুল, হানিফ ও আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, মহিলা শ্রমিকরা পুরুষদের সমান কাজ করলেও তাদের মজুরি কম দেওয়া হয়। মহিলাদের অন্য কাজের সুযোগ কম বলে মালিকরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের ঠকিয়ে থাকে।
ময়মনসিংহের মতি, শানু সর্দার ও বরিশালের মঞ্জুরুল হক ফকির সর্দার স্বীকার করেন, একই শ্রম দিলেও নারীদের মজুরি কম। সহজে নারী শ্রমিক পাওয়া যায় বলে তারা এ বৈষম্যের শিকার বলে জানানো হয়।
মিল মালিকদের বক্তব্য
আশুগঞ্জের বয়লার মালিক কামরুজ্জামান রিপন, আতাউর রহমান সেলিম, জাকির হোসেন জানান, এ কথা সত্য যে, অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে এ পেশায় বেশি খাটুনি হলেও নারী শ্রমিকরা সেই তুলনায় সন্তোষজনক পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন নিয়ম ও প্রথার কারণে এ পদ্ধতি পরিবর্তন করা যাচ্ছে না বলে তাদের মন্তব্য।
সমিতির বক্তব্য
চাল কল মালিক সমিতির সভাপতি হাজী রফিকুল ইসলাম স্বীকার করেন, চাতাল শ্রমিকদের শ্রমের কারণে আজ আশুগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকায় প্রতিদিন ৫০-৬০ হাজার মন চাল পাঠানো হচ্ছে। তারপরও চাতার শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১২