ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

যে গ্রামের চোর-ডাকাতরা এখন রেমিটেন্স যোদ্ধা!

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০২২
যে গ্রামের চোর-ডাকাতরা এখন রেমিটেন্স যোদ্ধা!

মেহেরপুর: অভিশপ্ত একটি গ্রামের নাম ছিল মেহেরপুরের ট্যাংগার মাঠ। মেহেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে কুতুবপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম এটি।

গ্রামটির মসজিদের বর্তমান মোয়াজ্জিন ও খণ্ডকালীন ইমাম আকবার আলীও ছিলেন শীর্ষ ডাকাত।  

এক সময় এ শীর্ষ ডাকাতের হাত ধরেই এ গ্রামের কয়েকশ’ লোক জড়িয়ে পড়েছিলেন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপকর্মে।  

সেই ডাকাত আকবার আলীই আজকের হাজি আকবার আলী। বর্তমানে তিনি কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও ট্যাংগার মাঠ গ্রাম আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। সেই সঙ্গে তিনি গ্রামের জামে মসজিদের মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন।

চোর-ডাকাতের সেই ট্যাংগার মাঠ এখন প্রবাসীদের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি। গ্রামে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। নিজেদের পরিবারের অর্থনৈতিক  উন্নতির পাশাপাশি দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন তারা।  অপরাধীর গ্রাম হিসেবে পরিচিত সেই ট্যাংগার মাঠের নামটিও পরিবর্তন করে এখন হয়েছে শিশিরপাড়া।  

মানুষকে কেউ এখন আর চোর, ডাকাত বা অপরাধী বলে গালি দেয় না। এ গ্রামের ঘরে ঘরে এখন সুখ ও শান্তির সুবাতাস। ছোটরা এখন চুরিবিদ্যা নয়, সবাই শিখছে লেখাপড়া। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়েও লেখাপড়া করছেন  ট্যাংগার মাঠ গ্রামের ছেলে-মেয়েরা।
 
কৃষক হজরত আলী, জাহিদুল ইসলাম ও রেবেকা খাতুন জানালেন, এক সময়কার আলোচিত ট্যাংগার মাঠ গ্রামের মানুষ অপরাধ জগৎ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কেউ এখন ওদের নামের শেষে চোর কিংবা ডাকাত বলে না। এলাকায় বা আশে-পাশের গ্রামে ডাকাতি কিংবা চুরি হলে কেউ এখন আর খোঁজ করতে ট্যাংগার মাঠে আসে না। মানুষ সবাই এখন কর্মব্যস্ত। কেউ ব্যবসায়ী কিংবা কেউ দিনমজুর। এ গ্রামের প্রায় এক হাজার লোক সৌদি আরব, ওমান, বাহারাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপম বিভিন্ন দেশে আছেন। তারা প্রতিমাসেই মোটা অংকের টাকাপাঠাচ্ছেন পরিবারের জন্য। প্রতিটি পরিবারেই এখন স্বচ্ছলভাবে জীবন যাপন করছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যই এখন প্রবাসী। এক সময়ের চোরের গ্রাম এখন প্রবাসীদের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

কলেজছাত্র লিজন শাহ, স্কুলছাত্র রাসেল আহম্মেদ, শাহ আলমজানান, এ গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪৫ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। এছাড়া পাশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ গ্রামের ১৬ জন, কলেজে আটজন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন লেখাপড়া করছেন। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছেন। এজন্য প্রয়োজনে অনেকেই শহরে গিয়ে অবস্থান করছেন।
কথা হলো ট্যাংগার মাঠ গ্রামের এক সময়ের শীর্ষ ডাকাত বর্তমানে মোয়াজ্জিন আকবর আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি ছিল ভারতের করিমপুর থানার রহমতপুর গ্রামে। ১৯৪৭ সালে আমরা সপরিবারে বাংলাদেশে এসে গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাজিপুর গ্রামে আশ্রয় নিই। এখানে আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে একটি গোষ্ঠী। পরে সেখান থেকে সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে চলে আসি। তৎকালীন হিন্দু জমিদার রাজলক্ষ্মী গংদের কাছ থেকে মেহেরপুর থানাপাড়ার আনোয়ার হোসেন ও হজরত আলী ৭০০ বিঘা জমি বিনিময় সূত্রে নেন। ১৯৬৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারা বিনিময় সূত্রে নিলেও শ্যামপুর, বেলতলাপাড়া, ঝাউবাড়িসহ আশেপাশের লোকজন তাদের সেই জমি দখল নিতে দেননি। পরে নজরুল ইসলাম আমাদের ৫০ জন লোককে ৫০ বিঘা জমি লিখে দেওয়ার শর্তে প্রথমে এ ট্যাংগার মাঠ গ্রামে বসতি গড়ার প্রস্তাব দেন। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে গ্রামটিতে আমি জুলমত হোসেন, আলী হোসেন, তাহের আলী, আসমত আলী, আমির, আকবর আলী, মজিব আলী, এলকাত হোসেনসহ ৩০টি পরিবার বসবাস শুরু করে গ্রাম গড়ে তুলি। ওই সময় ভারত থেকে গরু চুরি করে আনতাম। পরে এক সময় এলাকার লোকজনের গরু চুরি করা হতো। ধীরে ধীরে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ি গ্রামের সবাই।
সীমান্তের ওপারে ভারতে অপরাধ করতে গিয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে গ্রামটির ১৫ জন ডাকাতের প্রাণ গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু ডাকাত, আসমত ডাকাত, পচা ডাকাত, ছলিম ডাকাত, আবুজেহেল ডাকাত, ফড়িং ডাকাত।

১৯৮৮ সালে তৎকালীন মেহেরপুরের পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দীন ও জেলা প্রশাসক মহিউদ্দিন এ গ্রামের ডাকাত সর্দার আকবর আলী ও তার ডাকাত দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। সব ধরনের সহযোগিতা ও মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার আশ্বাস দিলে অপরাধ জগৎ থেকে ফিরে আসার ঘোষণা দেন অপরাধীরা। প্রাশাসনের সহযোগিতায় অপরাধ জগৎ থেকে ফিরে আসার শপথ নেন। সেই সময় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার তাদের প্রত্যেক পরিবারকে এক মণ করে চাল দিয়ে সহযোগিতা করেন।  

গ্রামের লোকজন পুকুর খনন ও মাছ চাষের পাশাপাশি যুবকদের বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে গ্রামের ডাকাত সর্দার আকবর আলীকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। এরপর প্রতিটি বাড়ির লোকজনের সমন্বিত উদ্যোগে প্রতি বছরে একজনকে বিদেশে পাঠাতে শুরু করেন তারা। এখন গ্রামের অনেকেই বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এখন আর তাদের কোনো অভাব নেই। তারা এখন সবাই সৎভাবে উপার্জন করছেন।

ট্যাংগার মাঠ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবেদ আলী জানান, বছর দশেক আগেও এ গ্রামের লোকজন তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাইতেন না। কিন্তু এখন এ গ্রামের সব ছেলে-মেয়েই স্কুল-কলেজ ও বিশ্বসবিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। এখন গ্রামের কেউ অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত নন। সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।

গ্রামের রমেছা খাতুন, নেকজান নেছা, আলেয়া বেগম, আব্দুল হামিদ, সাবু ডাকাতসহ বেশ কয়েকজন জানান, অভাবেরতাড়নায় গ্রামের লোকজন এক সময় নানা অপরাধে জড়িত ছিলেন। সে সময় আশপাশের এলাকার লোকজন তাদের ঘৃণা করতেন। কেউ আত্মীয়তা করতে চাইতেন না। এখন এ গ্রামের লোকজন কোনো অপরাধে জড়িত নন। কেউ আর এ গ্রামের লোকজনকে ঘৃণা করেন না।

কুতুবপুর ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনিছুর রহমান জানান, ওয়ার্ডটিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৪২৫। অর্ধেকের বেশি নারী ভোটার। গ্রামের প্রায় ১২শ’ মানুষ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। বাকিরা কৃষক, রাজমিস্ত্রি, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও অন্যান্য পেশায় জড়িত।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।